নায়করাজকে মনে পড়ে…
বিনোদন ডেস্ক :
পুরনো জমিদার পরিবারের এক আদুরে সন্তান ঢাকায় এসে আশ্রয় নেন শরণার্থী শিবিরে। এর পর জীবনের সঙ্গে ক্রমেই সংগ্রাম করে, বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে একদিন হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের বাংলা চলচ্চিত্রের এক রাজপুত্র। আস্তে আস্তে ঢালিউড নামক রাজ্যের এক রাজাধিরাজে পরিণত হন। সেই রাজাধিরাজের নাম ছিল আব্দুর রাজ্জাক। ভালোবেসে মানুষ যাকে উপাধি দেয় নায়করাজ।
নায়করাজ পৃথিবীতে নেই আজ ছয় বছর। আর তিনি অভিনয় ছেড়েছিলেন আট বছর আগে। তার পুত্র বাপ্পারাজের পরিচালনায় কার্তুজ ছবিতে অভিনয় করেন ২০১৫ সালে। আনুষ্ঠানিকভাবে এটাই তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। তার না থাকার এই সময়টা চলচ্চিত্র পিছিয়েছে আরও কয়েক বছর। চলচ্চিত্র নানাবিধ সংকটে হয়েছে বিপর্যস্ত। ভালো গল্প, চিত্রনাট্য, গান কিছুই নেই এখন। এক-দুজন নায়ক নিজেদের কব্জায় রেখেছেন পুরো ইন্ডাস্ট্রি, বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকশ সিনেমা হল। অথচ নায়করাজ দীর্ঘ ৫০ বছরের ক্যারিয়ারে চলচ্চিত্রকে যা দিয়ে গেছেন, তা দিয়ে এই অঙ্গন এগিয়ে যেত পারত। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন নায়করাজের কাজ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তার দেখানো পথে হাঁটলে, ইন্ডাস্ট্রি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা সিনেমাই এদেশে রাজত্ব শুরু করে। বন্ধ হয় ভিনদেশি সিনেমা, যার নেতৃত্ব দেন নায়করাজ। অসাধারণ সব চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে থাকেন। জুটি গড়ে তোলেন একাধিক নায়িকার সঙ্গে। বিশেষ করে কবরী-রাজ্জাক জুটি তো ওপারের উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতোই একের পর এক কালজয়ী সিনেমা উপহার দেয় দর্শকদের। শুধু কবরী নন, ববিতা, সুচন্দা, সুজাতা, শবনমের সঙ্গেও যেমন জুটি গড়েন, তেমনি উর্দু ছবির নায়িকা শাবানাকে বাংলা ছবিতে তিনিই সুযোগ করে দেন, দুজনের জুটিতে দারুণ কিছু ছবিও তৈরি হয়। রাজ্জাক ছিলেন রোমান্টিক নায়ক, ভিন্ন ভিন্ন সব চরিত্রে নিজেকে প্রমাণও করেছেন বারবার। রোমান্টিক ইমেজের বাইরে গিয়ে জীবন থেকে নেয়া, আলোর মিছিল, ওরা ১১ জন, ছুটির ঘন্টা, অবাক পৃথিবী, অশিক্ষিত, রংবাজ, গুণ্ডা, ঝড়ের পাখি, স্লোগান, বড় ভালো লোক ছিলর মতো চমৎকার সব ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের চলচ্চিত্রে অভিনয় করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অধরা এক অনন্য উচ্চতায়।
হতে চেয়েছিলেন ফুটবলার। আন্তঃস্কুল ফুটবলে খেলতেন, ছিলেন গোলকিপার। কলকাতায় তখন ফুটবলাররা সুপারস্টার হিসেবে গণ্য হতেন। একদিন গোলবারে একটা বল ধরতে গিয়ে স্ট্রাইকারের প্রচণ্ড জোরে মারা লাথি লাগে বুকে। তার পর থেকেই গুডবাই জানান সাধের ফুটবলকে। মনোযোগ দেন অভিনয়ে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই প্রথম মঞ্চে অভিনয় করেন। এর পর নিয়মিত মঞ্চ আর নাটক নিয়ে পথ চলতে থাকেন। এপার বাংলায় আসার আগে কলকাতায় তিনটি সিনেমায়ও অভিনয় করেন। সেখান থেকে একদিন মুম্বাই চলে যান। মুম্বাইয়ে সুবিধা করতে না পেরে সিনেমার নায়ক হওয়ার আশায় একদিন পা রাখেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে সিনেমাপাড়ায় ঘোরাঘুরি করতেন, কাজের জন্য নানা জায়গায় ধরনা দিতেন।
একসময় পরিচালক কামাল আহমেদের সঙ্গে ফোর্থ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে একদিন কিংবদন্তি পরিচালক জহির রায়হানের নজরে পড়েন। তার সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ নিয়ে সিনেমা বানানোর কথা বলে রাজ্জাককে সেই সিনেমার নায়ক বানাতে চান তিনি; কিন্তু নানা কারণে সেই সিনেমাটি আর হচ্ছিল না। তাতে আরও হতাশ হয়ে পড়েন রাজ্জাক। একদিন হঠাৎ করে একটা টিভি ধারাবাহিকে অফার পেয়ে বসেন, যার নাম ছিল ‘ঘরোয়া’। সেখানে অভিনয় করে সংসারের টানাটানি কিছুটা দূর হয়েছিল। এর মধ্যে খবর পান জহির রায়হান তাকে খুঁজছেন। দেখা করেন জহির রায়হানের সঙ্গে। গিয়ে শোনেন এই খ্যাতিমান পরিচালকের নতুন ছবি ‘বেহুলা’য় তাকেই নায়ক হিসেবে নিতে চান জহির রায়হান; কিন্তু ছবির প্রযোজক বেঁকে বসেন। শওকত আকবর, হাসান ইমাম, রহমানের মতো তুখোড় অভিনেতা থাকতে নতুন একটি ছেলেকে তারা মেনে নিতে পারছিলেন না; কিন্তু জহির রায়হানের জেদের কারণে তাকে নিতে বাধ্য হন প্রযোজক। এর পর রাজ্জাককে দিয়ে ছবির একটি গানের শুটিং করে প্রযোজককে দেখানো হলো। এবার খুশিমনে তিনিও মেনে নেন। নায়ক হিসেবে অভিনীত প্রথম সিনেমার সাইনিং মানি পান ৫০০ টাকা।
১৯৬৬ সালে মুক্তি পায় ‘বেহুলা’। লখিন্দররূপে রাজ্জাক ও বেহুলারূপে সুচন্দার অভিনয় মুগ্ধ করে সবাইকে। ছবিটি সুপারহিট হয়ে যায়। এর পর একের পর এক চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোতে অভিনয় করতে থাকেন।