উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর ন্যায্য অংশ নিশ্চিত করা সবার কর্তব্য
সিলেটের সময় ডেস্কঃ
পিতার সম্পত্তিতে নারীর এই নির্দিষ্ট অংশ পাওয়ার অধিকার ইসলাম ও আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে স্বীকৃত। এটা মহান আল্লাহর বেঁধে দেওয়া আইন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন : এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান। কিন্তু শুধু কন্যা যদি দুইয়ের অধিক থাকে, তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ।
আর মাত্র একজন কন্যা থাকলে তার জন্য (পুরো সম্পদের) অর্ধাংশ…। এটা আল্লাহর নির্ধারিত অংশ। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১১)
এই আইন অমান্য করা আল্লাহকে অমান্য করার শামিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলেই নারীরা তাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। আইন অনুসারে কন্যাসন্তানকে সম্পত্তির অংশ দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে তারা এর সুফল পাচ্ছেন না। দেশের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল ছাড়া প্রায় সবখানেই কন্যাসন্তানদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার একটি সামাজিক প্রচলন তৈরি হয়ে গেছে। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে নারীদের বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে বিভিন্ন প্রথা গড়ে উঠেছে। কোনো কোনো সমাজের নিয়ম হলো, উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনের সময় নারীকে তার অংশ দেওয়া হয়; কিন্তু নারী তার সম্পত্তি গ্রহণ না করে ভাইদের জন্য তার অংশটুকু ছেড়ে দেন। এটাই সামাজিকতা! এটাই সমাজের নিয়ম! এই প্রথার বাস্তবায়নে নারীদের মধ্যে স্বার্থবাদী সমাজ এক বিশেষ ধারণা তৈরি করেছে। তা হলো, পিতার সম্পত্তির অংশ গ্রহণ করলে ভাইদের কাছে ভবিষ্যতে বোনদের আর কোনো দাবিদাওয়া থাকবে না। মামাবাড়িতে থাকবে না ভাগ্নে-ভাগ্নি কিংবা বোনজামাইয়ের কদর! সুতরাং জমির দাবি উত্থাপন করে ভাইদের সঙ্গে বাদানুবাদে না জড়ানোই শ্রেয় মনে করেন তাঁরা।
আবার কোনো কোনো অঞ্চলে তো নারীদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি বঞ্চিত করার জন্য একটি কুসংস্কারই ছড়ানো হয়েছে, যে বাবার বাড়ির সম্পত্তি আনলে সংসারে অভাব-অনটন দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। একসময় সম্পত্তি আনা নারীটির সংসার নিঃস্ব হয়ে যায়। কোথাও কোথাও আবার কন্যাসন্তানদের বঞ্চিত করা হয় ভিন্ন প্রতারণার মাধ্যমে। উত্তরাধিকার সম্পত্তি হস্তান্তর না করে নামেমাত্র মূল্য দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয় নারীদের। অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণা করার জন্য তাদের প্রাপ্য অংশের পরিমাণও গোপন করা হয়। কেউ আবার প্রভাব খাটিয়ে, হুমকিধমকি দিয়ে বোনদের প্রকাশ্যে বঞ্চিত করে দেয়, এ ধরনের পারিবারিক জটিলতাগুলো অনেক সময় জনপ্রতিনিধিরাও সমাধান করতে পারেন না।
অথচ পবিত্র কোরআন-হাদিসে আত্মীয়দের অধিকার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দিয়ে দেওয়ার জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে তার অধিকার দিয়ে দাও…। ’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৬)
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তাঁর এবং কয়েকজন লোকের মধ্যে বিবাদ ছিল। আয়েশা (রা.)-এর কাছে উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, হে আবু সালামা, জমির ব্যাপারে সতর্ক থাকো। কেননা, নবী (সা.) বলেছেন, যে লোক এক বিঘত জমি অন্যায়ভাবে নিয়ে নেয়, (কিয়ামতের দিন) এর সাত তবক জমি তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। (বুখারি, হাদিস : ২৪৫৩)
উপরোক্ত আয়াত ও হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার অধিকার রক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। সৃষ্টির অধিকারের পরিধি কতটুকু হবে, তা সৃষ্টিকর্তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের যাবতীয় বিষয় তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে আমাদের কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে তাঁর চেয়ে বেশি অবগত কেউ নয়। তাই তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য অধিকারের যে সীমারেখা দিয়েছেন, সেটাই চূড়ান্ত সীমারেখা। মানুষ এর বাইরে গিয়ে তাদের নিজেদের জন্য কোনো কল্যাণকর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত। ’ (সুরা মুলক, আয়াত : ১৪)
ইসলামের উত্তরাধিকার নীতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি নীতি। এই নীতির প্রণেতা মহান আল্লাহ। যিনি একমাত্র ইনসাফদাতা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪০)
তাই মানবাধিকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ যে নীতিমালা দিয়েছেন, সেটাই যথার্থ নীতিমালা। অনেকের মনে হতে পারে, ইসলামে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টননীতিতে নারীরা কম পাচ্ছে: কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসলামে নারীদের উত্তরাধিকারনীতির পাশাপাশি নারীদের অন্য দায়িত্বগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম নারীদের বণ্টননীতির ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করেনি। যেমন—ইসলাম খরচের নীতির ক্ষেত্রে বেশির ভাগ পুরুষের দায়িত্বে রেখেছে। এর বিপরীতে নারীদের দায়িত্বে কিন্তু তা সেভাবে দেওয়া হয়নি। একজন নারীর ব্যক্তিগত খরচগুলোর দায়িত্বও পুরুষের ওপর দিয়ে রাখা হয়েছে। নারী যখন কন্যা, তখন তার পরিপূর্ণ ভরণপোষণের দায়িত্ব তার বাবার, বাবা মারা গেলে তার ভাইয়ের। এমনকি হাদিস শরিফে কন্যা বা বোনদের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আবার নারীর যখন বিয়ে হয়ে যায়, তখন তার ভরণপোষণের দায়িত্ব তার স্বামীর ওপর বর্তায়, স্বামীর অবর্তমানে সন্তানদের ওপর বর্তায়।
আবার নারীরা স্বামীর কাছ থেকে মোহর পায়, কিন্তু পুরুষরা এমন কিছু পায় না। এভাবে মহান আল্লাহ বহু জটিল ও বড় বড় খরচের খাত থেকে নারীদের মুক্ত রেখেছেন; বরং তাদের খরচের দায়িত্বটুকুও পুরুষের ওপর দিয়ে রেখেছেন। আবার উত্তরাধিকার হিসেবে তারা অনেক ক্ষেত্রে (যখন ভাই থাকে না) অন্য পুরুষ উত্তরাধিকারদের চেয়ে বেশি সম্পত্তি পায়। সেদিক থেকে সম্পত্তি বণ্টনের যে সূক্ষ্ম নীতিমালা ইসলাম দিয়েছে, তা বৈষম্যমূলক হওয়ার সুযোগ নেই।