জমেছে নির্বাচনী কূটনীতি
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক তৎপরতা সব সময়ই চলে। এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। তবে বিএনপি মহাসচিবের জাতিসংঘে বৈঠকসহ আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক পদক্ষেপের ব্যাপারে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই খোঁজ রাখছে মন্ত্রণালয়।
বিশ্নেষকরা বলছেন, নির্বাচন এলে বিদেশিদের সঙ্গে নানা রকম দেন-দরবার শুরু হয়। এটা রাজনীতির জন্য শোভন না হলেও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় তা নতুন কিছু নয়।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, গত প্রায় এক মাসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশের ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, গণফোরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আলোচনার ধরনটা মূলত চা-চক্র। এসব আলাপের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গই মুখ্য ছিল। তবে নির্বাচনের বাইরে রোহিঙ্গা সংকটসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুও স্থান পায়। সূত্র জানায়, বৈঠকগুলোতে সিদ্ধান্তমূলক কিছুই ছিল না। আগামীতেও জাতীয় নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক চলতেই থাকবে।
একটি পশ্চিমা কূটনৈতিক সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচন একান্তই বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। এ নিয়ে কূটনীতিকদের করার কিংবা বলার কিছুই নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়ার মতো দেশগুলো বিশ্বের প্রায় সব দেশের জাতীয় নির্বাচনের দিকে সতর্ক নজর রাখে। এসব প্রভাবশালী দেশের বাণিজ্যিক ও কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্নিষ্ট নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রগুলো গতিশীল রাখার প্রয়োজনেই তাদের বিশ্বব্যাপী সব অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থার প্রতি নজর রাখতে হয়। আবার উপমহাদেশে যে কোনো দেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের প্রবল আগ্রহ থাকে- তেমনি ভারতের রাজনীতি ঘিরেও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গভীর আগ্রহ দেখা যায়। ফলে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ভারতের আগ্রহ অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি- এটাও স্বাভাবিক। যেমন প্রতিবেশী মেক্সিকো এবং কিউবার রাজনৈতিক অবস্থার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল আগ্রহ এবং গভীর নজরদারি দেখা যায়। ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দেশগুলোর তুলনায় ব্রাজিল ও ভেনিজুয়েলার নির্বাচন এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে।
সূত্রের মতে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত আঞ্চলিক সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের দিক থেকে পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থার দিকে সব সময়ই নজর রাখে এসব দেশ। নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতি যেহেতু সবচেয়ে বেশি আলোড়িত হয়, সে কারণে আগ্রহটাও অনেক বেশি। এই সূত্র আরও জানায়, সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়ে খোঁজ রাখা জাতিসংঘের এখতিয়ার ও দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। যে কারণে জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়। রাজনৈতিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে আলাপ-আলোচনার জন্য এর আগেও জাতিসংঘের বিশেষ দূত বাংলাদেশে এসেছেন। ভবিষ্যতেও প্রয়োজন হলে আসতে পারেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, কূটনীতিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা খুব সাধারণ বিষয়। এটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার কিছু নেই। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বা নিয়মতান্ত্রিক কূটনৈতিক তৎপরতার প্রতি মন্ত্রণালয় স্বাভাবিক নিয়মইে নজর রাখে এবং রাখছে। বিএনপি মহাসচিব জাতিসংঘে কার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, কী আলাপ হয়েছে- প্রতিটি বিষয় সম্পর্কেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খোঁজ রাখছে।
নির্বাচন ঘিরে কূটনৈতিক তৎপরতার ব্যাপারে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্নেষক হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, নির্বাচন এলে দেশে কিছু রাজনৈতিক সংকট বরাবরই দেখা দেয়। বিশেষ করে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহ থেকেই সংকটের সৃষ্টি হয়। এখন যদি আমরা নিজেরা আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করে ফেলি তাহলে বিদেশি কূটনীতিকরাও কথা বলার সুযোগ পাবেন না, জাতিসংঘ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার দূত আসারও প্রয়োজন হবে না। যেসব দেশে এ ধরনের সংকট আছে, সেসব দেশে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা দূত পাঠায়। বাংলাদেশ যদি সেসব দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে পারে, সেটাই হবে সবচেয়ে সম্মানজনক।
বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রতি আস্থা হারিয়ে বিদেশি শক্তির সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে কেউ ক্ষমতায় থাকতে চায়, কেউ ক্ষমতায় যেতে চায়। এটি ভালো কোনো রাজনৈতিক চর্চা নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচনের আগে এ ধরনের চর্চা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন এলেই বিদেশিদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দেন-দরবার বেড়ে যায়। এ পরিস্থিতি রাজনীতিবিদদের জন্য যেমন সম্মানজনক নয়, তেমনি গণতন্ত্রের জন্য মোটেও সুখকর নয়।