শিরোপার হাতছানি নিদাহাস ট্রফি: মোছাদ্দিক আহমদ তোফায়েল
প্রচণ্ড একটা ঝড়ের পর চারপাশটা যেমন নীরব হয়ে থাকে, স্তব্ধ হয়ে থাকে সবকিছু, প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামটা এখন তেমনই। মাঠের কিছু মানুষ চাকরি বাঁচাতে বিষণ্ণ মনে ঘাস কেটে যাচ্ছেন! টিকিট কাউন্টারের একজন বসে আছেন শুকনো মুখে! টাই পরে এতদিন ঘুরে বেড়ানো লংকান কর্মচারীদের দেখা মেলেনি কাল। ভারত মহাসাগর পাড়ে আজকের ফাইনাল নিয়ে কলম্বো যতই নিষ্পৃহ থাকুক না কেন, বঙ্গোপসাগর পাড়ে যে উথালপাতাল চলছে, তা আন্দাজ করা যায়।
লংকার বিপক্ষে যদি সেদিন ‘প্রতিশোধ’ নেওয়া হয়ে থাকে, আজ তাহলে ভারতের বিপক্ষে ‘বদলা’ নেওয়ার সুযোগ। ব্যাঙ্গালুরু থেকে মিরপুরে এশিয়া কাপের ফাইনাল- বারবার ছায়ায় মিলিয়ে গেছে জয়। বারবার আহত হয়েছে হৃদয়। তবে আজ আর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নয়। আজ আর ঢাল নয়, তলোয়ার চালানোর দিন! ‘এটা ঠিক যে ফাইনাল ম্যাচে নামছি আমরা, তবে এই ম্যাচ ঘিরে অযথা উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা রিলাক্স থেকেই মাঠে নামব এদিন।’ সৌজন্যের খাতিরেই বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে কথাগুলো বলছিলেন সাকিব।
আজ বাংলাদেশের সামনে শিরোপা জয়ের হাতছানি।
আসলে কৌশলগত কারণেই ম্যাচের আগে খুব বেশি কথা বলতে চাচ্ছেন না বাংলাদেশ অধিনায়ক। ম্যাচের আগে যতটা সম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রাখতে চাইছেন তিনি। ভারতের বিপক্ষে এ পর্যন্ত সাতটি টি২০র সবগুলোতেই আফসোস করতে হয়েছে শেষে। তবে আজ ভারতের যে দলটি ফাইনালে নামবে, তারা ততটা অভিজ্ঞ নয়। আগের দিন মাঠে নাগিন ড্যান্স দিয়ে যিনি স্যোশাল মিডিয়ায় আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন, সেই খালেদ মাহমুদ সুজনের কথাতেই পরিস্কার, বড় ম্যাচের আগে যে পারদ থাকা দরকার, ড্রেসিংরুমে তার সবটুকুই আছে।
এদিন ঐচ্ছিক অনুশীলন থাকায় মাঠে আসেননি মুশফিক-তামিমদের কেউই। তবে সাকিব এসেছিলেন, প্রায় এক ঘণ্টা নেটে ব্যাটিং করে তিনি নিজের মতো নিজেকে তৈরি করে নিয়েছেন। আগের দুই ম্যাচে সাকিব ছিলেন না, তবে আজকের ফাইনালে সাকিব থাকছেন একেবারে সম্মুখ সমরে। আগের রাতে টেলিভিশনে হোটেল রুমে বসে বাংলাদেশের ম্যাচটি দেখেছিল ভারতীয়রা। ‘টেলিভিশনে দেখেছি বাংলাদেশের ম্যাচ। তারা জেতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আর এটাই এখন বড় দলগুলোর বৈশিষ্ট্য। আমরা জানি তাদের শক্তির জায়গাগুলো। তবে আমরা তৈরি আছি’- দিনেশ কার্তিক বলছিলেন গতকাল। এটাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, দ্বিতীয় সারির দল নিয়ে এলেও তাদের ভরসার জায়গা টপঅর্ডার ব্যাটিং। যেখানে ধাওয়ান, রোহিত, রায়নারা রয়েছেন দারুণ ফর্মে।
এদিন ভারতীয় দলের সঙ্গে থাকা কম্পিউটার বিশেষজ্ঞকে দেখা গেল নেটের পাশেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকতে। সেখান থেকেই আগের ম্যাচে বাংলাদেশি বোলারদের করা ডেলিভারিগুলো বিশ্নেষণ করে বলে দিচ্ছিলেন রবি শাস্ত্রীকে। নিদাহাস ট্রফি বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য নাকি সব প্রস্তুতি সেরে রেখেছেন শাস্ত্রী। নেটের পাশে দাঁড়িয়ে দিল্লি থেকে আসা ভারতীয় সাংবাদিক বলছিলেন আগ বাড়িয়ে। বাধ্য হয়েই তাকে শুনিয়ে দিতে হলো, আজ প্রেমাদাসার ডিজের কাছে একটি গানের অনুরোধ দিয়ে আসা হয়েছে- নাগিন… নাগিন…। সাকিবরা ট্রফি স্পর্শ করলেই আজ মাঠে বেজে উঠবে এই গান। অন্তত আহত লংকান বোর্ড এ আয়োজনটুকু রেখেছে শুধুই বাংলাদেশের জন্য।
পরপর দুই ম্যাচে লংকাকে বিধ্বস্ত করার পর আত্মবিশ্বাসে উদ্বেলিত বাংলাদেশ দল। তবে খুব সতর্কভাবে ক্রিকেটারদের ভেতরে জমে থাকা এই অনুভূতি চাপা রাখার চেষ্টা করছেন কোচ কোর্টনি ওয়ালশ। দলের একাদশে আজ কোনো পরিবর্তনের খবর নেই। সেদিনের সেই এগারো ক্ষিপ্র বাঘ নিয়েই আজ মাঠে নামবে বাংলাদেশ।
ফাইনাল জুজু কাটবে টাইগারদের
ওয়েস্ট ইন্ডিজে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে মাশরাফি-তামিম-সাকিবরা শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নব জাগরণের শুরু করেছিলেন। এরপর ২০০৯ সালে ঘরের মাঠে শ্রীলংকার সঙ্গে জিম্বাবুয়েকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ আয়োজন। তখন দাপুটে ক্রিকেট খেলেছিল টাইগাররা। তবে শ্রীলংকার বিপক্ষে ফাইনাল হেরে টাইগারদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। এরপর আরও চারটি ফাইনাল খেলেছে সাকিব-তামিম-মাশরাফিদের দল; কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হয়ে ঘরে শিরোপা সাজানো হয়নি।
নিদাহাস ট্রাফির ফাইনালে ভারতের বিপক্ষের ম্যাচ তাই শুধু ফাইনাল না! আগের পাঁচটি ফাইনালের হিসেব মেলানোর সুযোগ বলা চলে। ফাইনাল জিতে শিরোপা ঘরে তোলার সুযোগও বটে।
২০১২ সালের এই মার্চ মাসে এশিয়া কাপে ফাইনাল হেরে সাকিব-মুশফিক যেমন কাঁদেন, তেমিন কাঁদেন সারা দেশের মানুষ। এরপর ২০১৬ সালের মার্চে মিরপুরে টি২০ ফরম্যাটে হওয়া এশিয়া কাপের ফাইনালে আবার বাংলাদেশ। এবার প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের জায়গায় ভারত। কিন্তু ফলাফল সেই এক ‘রানার্স আপ’ বাংলাদেশ। আবার স্বপ্নভঙ্গ টাইগার সমর্থকদের।
২০১৭ সালের মে থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আরও তিনটি ফাইনালে উঠেছে টাইগাররা। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে নিউজিল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলে বাংলাদেশ। সেবারও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে যায় বাংলাদেশ; কিন্তু ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের কাছে হারে টাইগাররা।
আর দেশের মাটিতে সর্বশেষ ত্রিদেশীয় সিরিজের স্মৃতি তো এখনও দগদগে। ‘ফেরাবিট’ হিসেবে শুরু করা বাংলাদেশ ফাইনালে হারে শ্রীলংকার বিপক্ষে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ হেরেছে পাঁচ-পাঁচটি ফাইনালে। জয়ের কাছে গিয়েও শিরোপা ঘরে তোলা হয়নি।
এবার কি ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশর সেই ফাইনাল জুজু কাটাবে? পারবে বাংলাদেশ একটি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ট্রফি উচিয়ে ধরতে?