যে স্বপ্নের রং,গন্ধ ও স্বাদ তাঁর উপলব্ধ :
আসমা জান্নাত মনি:
স্বপ্নের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। স্বপ্নরাজ্যের বিভিন্ন স্তরে মানুষের অবাধ বিচরণ। তা সত্ত্বেও সব মানুষ কি স্বপ্নরাজ্যের সব স্তরে পৌঁছাতে পারে? হ্যাঁ পারে, যদি প্রতিটি মানুষ সব দিক দিয়ে সমান বিবেচিত হতে পারে। বিশ্বজগতে সবদিক বিবেচনায় প্রতিটি মানুষ সমান নয়, যেমন মানুষের স্বপ্নগুলোও সমান নয়। মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়। সুতরাং.
মানুষ কীভাবে তার স্বপ্নের সমান বড়? একজন মানুষ যত বড় স্বপ্ন দেখে জীবসত্ত্বার সীমানা পেরিয়ে তার সত্তা কি তত বড় স্তরে পৌঁছে যেতে পারে? হ্যাঁ পারে। প্রশ্ন জাগতে পারে যদি তাই হয় তবে সব মানুষ স্বপ্নের উচ্চ স্তরে বিচরণ করে ‘বড় মাপের’ মানুষের স্তরে ইতোমধ্যে পৌঁছে যেত। যেহেতু স্বপ্নরাজ্যে সবার অধিকার ও অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ রয়েছে, এবং স্বপ্ন দেখতে কোনো মূল্য লাগে না—কিন্তু বাস্তবিকই তা হয়নি কেন? মানব জাতির ইতিহাসে মানুষ যে সময় থেকে স্বপ্ন দেখতে শিখেছে, জীবসত্তার ঊর্ধ্বে গিয়ে সব মানুষ সমান ‘বড়’ হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ আমার আগের কথায় ‘স্বপ্নরাজ্যে সবার অধিকার ও অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ রয়েছে’—এটি সর্বাংশে সত্য হলেও বাক্যের আরেকটি অংশ, ‘স্বপ্ন দেখতে কোনো মূল্য লাগে না’—এই কথাটি সত্য নয়। স্বপ্ন দেখতে মূল্য লাগে। সবাই সব স্বপ্ন দেখার সামর্থ্য রাখে না। কোনো মানুষ স্বপ্নের কত গভীরে ও বৈচিত্র্যময় অংশে বিচরণ করতে পারবে তা নির্ধারিত হয় তার গুণাবলী ও যোগ্যতার বিচারে। ধ্যাত্মিক ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, চিন্তাশীলতা, জ্ঞান, শিক্ষা অভিজ্ঞতা, জীবনাবোধ প্রভৃতি এই গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। সুদূর তানজেনিয়ায় অবস্থিত সিরেঙ্গেটি পার্কের চিত্র আপনি ঘরে বসে ইন্টারনেটে একটা ক্লিক দিলেই দেখতে পারেন। কিন্তু পৃথিবীতে সিরেঙ্গেটি নামক যে একটি বিশাল পার্ক রয়েছে—এই তথ্যটি যদি আপনার না থাকে, তবে আপনি ইন্টারনেট রাজ্যে সার্চ দেবেন কীভাবে? স্বপ্নরাজ্যে স্বপ্ন দেখার বেলাতেও একথা সত্য।
আমি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম যখন আমি নিজেকে চিনতে পেরেছি।আমার অন্যতম একজন প্রিয় শিক্ষক স্কুল জীবনে একটা কথা প্রায়ই বলতেন……… “তুমি যদি বড় কোন গর্ত জাম্প করে পার হতে চাও তোমাকে গর্তটার সামনে থেকে একটু পিছিয়ে আসতে হবে, এরপর সজোরে দৌড় দিয়ে গতিশক্তি সঞ্চয় করেই জাম্প করতে হবে।”
ম্যাডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় যেসব পরিশ্রমী ছাত্র-ছাত্রীদের হারিয়ে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন পেজ এ তাদের কয়েকজনের গল্প পড়লাম। *অসুস্থ শরীর নিয়ে পড়াশুনা করেছে একজন, ইমিডিয়েট অপারেশন করানোর দরকার ছিল। প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটবে এই চিন্তায় ম্যাডিকেল ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল, ওজন নেমে এসেছিল ৩৫ কেজিতে।
*অন্য একজনের মা হজ্ব করার সময় হাজরে আসওয়াদে ছুঁয়ে একটা দোওয়াই করেছিল আমার ছেলেটাকে ডাক্তার বানিয়ে দিও। একবছর কয়েকমাস প্রাণপণ চেষ্টা করেছে মায়ের স্বপ্নটাকে ধরে আনবার জন্য।
*রেজাল্টের আগের দিন রাতে তিন বছরের ছোট বাচ্চাটা তার মায়ের সাথে সিজদায় পড়ে দোয়া করছে তার বোনটি যেন ডাক্তার হতে পারে।
হ্যা, কিছু সৎ , পরিশ্রমী, আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ মানুষের গল্প এইগুলো। জানি এই গল্পগুলোর চেয়ে হয়তো আরো অনেক ট্র্যাজিক গল্প লুকিয়ে আছে প্রতিটা ডেডিকেটেড ম্যাডিকেল ভর্তি পরীক্ষার্থীর জীবনে। গল্পগুলো হয়তো অপ্রকাশিতই থেকে যাবে। অপ্রিয় হলেও মানতে হবে এই পরাজয়ে অনেক দৃঢ় মনোবলের ফাইটাররা থেমে যাবে। জীবনে দ্বিতীয়বার আর কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার ইচ্ছে তাদের হবে না কখনো।
তোমরা যে স্বপ্নটা দেখেছিলে সেটাকে হয়তো একদিনেই পরিবর্তন করে অন্য একটা স্বপ্নে পরিণত করতে পারবে না। একটা স্বপ্ন একদিনে তৈরি হয় না আবার আরেকটি স্বপ্নকে নিজের ঠিকানা ভাবতে একটু সময় লাগবে তোমাদের। তোমরা চাইলে এখানেই থেমে যেতে পারো। আবার এটাও পারো, আর একবার… অন্তত জীবনের শেষ চেষ্টা মনে করে আর একবার ওঠে দাঁড়াতে। মানুষ যদি তার প্রথম দুই তিন চেষ্টাতেই থেমে যেত তাহলে বিশ্বাস করতে পারো এই পৃথিবীতে অনেক উদ্ভাবন সেখানেই থমকে যেত। তোমরা থেমে গেলে তোমাদের এই এক বছরের পরিশ্রম হারিয়ে যাবে চিরতরে। বিশ্বাস কর একদিন যে তুমি হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটেছিলে ভুলেও কেউ মনে করবেনা। আগামী প্রজন্ম হয়তো জানবেই না একটা প্রহসন মুলক নাটকের মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে তোমাদের হারিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এই অল্প সময়ের পিছিয়ে পড়াটাকে গর্ত পেরুনোর মত প্রেরণা দিয়ে আরেকবার জাম্প করো। ইঞ্জিনিয়ারিং, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথামেটিক্স, ফার্মাসী, ফ্যাশন ডিজাইনিং, রাজনীতি, পোরনীতি, ইতিহাস, অভিনয়, লেখনী, গান যে যেভাবেই পারো, যেটাতেই পার অন্তত আর একটাকে ধরে আবার একটা লক্ষ্য স্থির কর। রোমাঞ্ছকর সামরিক জীবন ভাল লাগলে সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর যেকোন একটার গর্বিত অফিসার হয়ে যেত পারো ইচ্ছে করলেই। এই একবছরের অধ্যবসায় আর কঠোর পরিশ্রম তোমাদের এক একজন কে অদম্য সক্ষমতা সম্পন্ন মানব সম্পদে পরিণত করেছে। নিজেকে আরেকবার বিশ্বাস করেই দেখ আর তুমি ঠকবে না।
জীবনের শুরুই তো কেবল মাত্র, একটা পরাজয় কি তোমাকে থামিয়ে দিতে পারে?? জীবনের ভোরবেলায় হাঁটতে যেয়ে কতবার পড়ে গিয়েছ কই হেরে যাওনি তো কখনো। কিছু দুর্নীতিবাজ মানুষের অপকর্মের শিকার হয়ে তুমি তোমাকে ধংস করবে কেন? শুধু মনে রেখ, আমাদের ম্যাডিকেল কলেজগুলোর এত বড় ভাগ্য হয়নি তোমাদের মত সাহসী কিছু সৈনিককে তার বুকে স্থান দেবার।
গর্তটাকে খুব ভালভাবে কাছ থেকে দেখে পিছিয়ে এসো। এরপর প্রস্তুতি নাও আর একটা জাম্প দেয়ার……… আমিও ঠিক এরকম ই স্বপ্ন দেখি আমি জীবনের কোন একটি ক্ষেত্রে সফল হয়ে একদিন হাজার হাজার মানুষের সামনে মাইক হাতে নিয়ে ঘোষণা করবো ২০১৭ সালের প্রহসন আমাকে থামিয়ে দিতে পারেনি।
লেখকঃআছমা জান্নাত মনি
মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ,ইংরেজী অনার্স (দ্বিতীয় বর্ষ)।