বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শহর সুনামগঞ্জ

।স্বপ্নের প্রকৃতিতে বসন্ত বাতাসে প্রাণের স্পন্দন ।

মবরুর আহমদ সাজু:অনেকেই সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে যান। কিন্তুু এর আশেপাশেই অনেক সুন্দর সুন্দর নয়নাভিরাম জায়গা আছে যা যে কোনো পর্যটকের মনকে মুহূর্তেই দোলা দিয়ে যেতে পারে ! মরমী কবি হাছন রাজা, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম, স্মৃতিবিজড়িত সুনামগঞ্জ তো প্রকৃতিপ্রেমীদের হাতছানি দিয়ে ডাকবেই। বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব সীমান্তে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের কোল ঘেষে সুনামগঞ্জ জেলার অবস্থান। এ জেলার উত্তরে রয়েছে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিণে হবিগঞ্জ জেলা, পূর্বে সিলেট জেলা এবং পশ্চিমে নেত্রকোনা জেলা। সুনামগঞ্জের ইতিহাস অতি প্রাচীন আর এই ইতিহাস এতিহ্য দেখতে হাওর পারে দেশের মানুষ আসে বারবর। হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার ভারতের খাসিয়া, মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত পর্যটন সমৃদ্ধ স্থানগুলোতে পর্যটক ও স্থানীয় জনসাধারণে পদচারনায় প্রতিবারই মুখরিত হয় । তবে সবচেয়ে আকর্ষনীয় তাহিরপুর উপজেলার টাংগুয়ার হাওর, সীমান্ত লেক ও বারেকটিলা। সারা বছরেই এই পর্যটন স্পটগুলো ভ্রমণ পিপাসুদের সাথে স্থানীয় জনসাধরণের পদচারণায় মুখরিত থাকে এখানে অসংখ্য কিংবদন্তী এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও তথ্যাবলীতে সমৃদ্ধ। প্রাচীন ইতিহাস থেকে অনুমান করা হয়, সুনামগঞ্জ জেলার সমগ্র অঞ্চল এককালে আসামের কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।জেলা তথ্যসূত্রে জানা যায় ‘সুনামদি’ নামক জনৈক মোগল সিপাহীর নামানুসারে সুনামগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ‘সুনামদি’ (সুনাম উদ্দিনের আঞ্চলিক রূপ) নামক উক্ত মোগল সৈন্যের কোন এক যুদ্ধে বীরোচিত কৃতিত্বের জন্য সম্রাট কর্তৃক সুনামদিকে এখানে কিছু ভূমি পুরস্কার হিসাবে দান করা হয়। তাঁর দানস্বরূপ প্রাপ্ত ভূমিতে তাঁরই নামে সুনামগঞ্জ বাজারটি স্থাপিত হয়েছিল। এভাবে সুনামগঞ্জ নামের ও স্থানের উৎপত্তি হয়েছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে।

অসংখ্য হাওর-বাওর, নদীনালা, খালবিলে পরিবেষ্টিত জনপদ সুনামগঞ্জ। এ জনপদে ঐতিহ্য সংস্কৃতি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সরব উপাদান। আউল-বাউলের চারণভূমি সুনামগঞ্জ তাঁর ঐতিহ্যের ধারা থেকে আজও বিচ্যুত হয়নি। লোকসাহিত্যে মহাভারতের অনুবাদক মহাকবি সঞ্চয় (পঞ্চদশ শতক), কুবের আচার্য্য, ঈশান নাগর (বৈষ্ণব কবি)দিব্য সিংহ (লাউর রাজ্যের স্বাধীন রাজা)থেকে শুরু করে সৈয়দ শাহনূর, সৈয়দ হোসেন আলম, রাধারমণ, হাছনরাজা, দুরবীণ শাহ, কালাশাহ, ছাবাল শাহ, এলাহী বক্স মুন্সী, শাহ আছদ আলী, পীর মজির উদ্দিন, আফজল শাহ, শাহ আবদুল করিম এ মাটির সন্তান। পর্যটক, সৌন্দর্য পিপাসুসহ সবার উপস্থিতিতে। এখানে বিভিন্ন উৎসব ছারাও ছুটির দিনে আসেন সহস্রাধিক পর্যটক আসেন প্রকৃতির সান্নিধ্যটুকু লাভ করার জন্য । কেউ মটর সাইকেলে, কেউ সিএনজি, কেউ স্পিড বোডে আবার কেউ ইঞ্জিন চালিত নৌকায় দলবেধে ছুটছে। তাহিরপুর উপজেলায় রয়েছে-মাদার ফিসারিজ খ্যাত টাংগুয়ার হাওর বাংলাদেশের বুকে এক উজ্জল নক্ষত্রের নাম, সীমান্ত ঘের্ষা ৩শ’ ফুট উচ্চতার বারেক টিলা, উপজাতিদের মন্দির, মেঘালয় পাহাড়ের জলপ্রপাত, শাহ আরফিন (রা) আস্তানা, সনাতন হিন্দু-ধর্মাবলাম্বীদের পনর্তীথ স্থান, উঁচু নিচু পাহাড়ের সারি, গন-সবুজের সমারোহ, ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্প, সীমান্ত লেক, ৩টি শুল্ক ষ্টেশন (চারাগাঁও,বড়ছড়া,বাগলী), মুক্তিযোদ্ধের সৃত্মি চিহ্ন, ছোট বড় ২০টি ভারতের মেঘালয়ের বুক চিড়ে নেমে আসা পাহাড়ী ছড়া, রাজা উইক্লিবস এর বাড়ি, আওলী জমিদার বাড়ি, পাহাড়ী যাদুকাটা নদী, ঝর্না, মেঘ, বৃষ্টি,উপজাতি ও বাংলাদেশীদের একত্রে বসবাসের এক মিলন মেলা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মনোরম পরিবেশ বিরাজ করছে সীমান্তবর্তী তাহিরপুর উপজেলায়। দোয়ারাবাজার উপজেলায় রয়েছে-বাঁশতলা, হকনগর শহীদ স্মৃতিসৌধ, জুমগাঁও আদিবাসী সহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলো যা পর্যটকদের কে নয়ানাভিরাম, নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ করায় বার বার আসছেন দেশ-বিদেশী হাজার হাজার দর্শনার্থী। অনেকেই ওইসব স্থানে গিয়ে তুলছেন সেল্ফি আর অনেকেই একান্তে বসে আছেন আবার অনেকেই বসিয়েছেন মন খুশি আড্ডা। সবার আকর্ষণ টাংগুয়ার হাওর। এ হাওরের একটি প্রবাদ আছে-নয়কুড়ি বিল, ছয় কুড়ি কান্দার টাংগুয়ার হাওর। জেলা তথ্যসূত্রে জানা যায় এখানে নানা প্রজাতির বনজ ও জলজ প্রানী এ হাওরের সৌন্দর্য কে আরো দর্শনীয় করেছে। বর্ষায় টাংগুয়ার হাওর এক বিশাল সমুদ্রের রূপ ধারণ করে আর শীতের সময় টাংগুয়ার হাওর কে আরো আকর্ষনীয় করে তুলে। অনুপম সৌন্দর্যে ভরপুর কোলাহলমুক্ত পরিবেশ, কোথাও সবুজ ক্ষেত, নিবিড় অরণ্য প্রকৃতিলতা দেখে আনমনা হয়ে গেয়ে উঠতে পারেন-

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্ম ভূমি ”
সুনামগঞ্জ পর্যটকদের কাছে অতি প্রিয় একটি নাম। ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবলে সুনামগঞ্জ হতে পারে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। সুনামগঞ্জ বেড়ানোর জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে।’ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, উৎসব-আনন্দ, অকৃত্রিম জীবনাচার বৃহত্তর সুনামগঞ্জ করেছে সমৃদ্ধ। এছাড়া এ জনপদের মানুষ বিশ্বের আধুনিক বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে উন্নত জীবনমানের সাথেও পরিচিত ও অভিজ্ঞ। মানুষ আর প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে অর্থনীতির বিপ্লব ঘটতে পারতো সুনামগঞ্জ সহ সারাদেশে। প্রয়োজন একটি মহাপরিকল্পনা। সরকারের আন্তরিক উদ্যোগেই পারে পর্যটন শিল্পের কাক্সিক্ষত বিকাশ ও প্রকাশ ঘটানো এবারের আয়োজন সুনামগঞ্জর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা লিখছেন মবরুর আহমদ সাজু
১.ফুল বাগান প্রাণের স্পন্দন
সারা বছর দর্শনার্থীদের ভিড় থাকলেও বেশি ভিড় হয় বসন্তকালে। যখন গাছে গাছে শোভা পায় রক্তলাল শিমুল ফুল ১০০ বিঘার বেশি জায়গা জুড়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে জাদুকাটা নদীর তীরে রয়েছে শিমুল ফুলের বাগান। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, মাঝে যাদুকাটা নদী আর এপারে শিমুল বন। সব মিলে সেখানে গড়ে উঠেছে প্রকৃতির এক অনবদ্য রূপ। জায়গাটা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার লাউয়ের গড়। ১৪ বছর আগে ২ হাজার ৪০০ শতক জমিতে শখের বসে এই শিমুল বাগান গড়ে তোলেন জয়নাল আবেদীন নামে স্থানীয় একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। বসন্ত এলে যখন একসাথে দুহাজার গাছ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে তখন পর্যটকদের মন নেচে ওঠে । কখন শিমুল বনের রক্তরাঙ্গা সৌন্দর্য দেখতে হলে ফাল্গুন মাস সেখানে যাওয়ার উপযুক্ত সময়।
কীভাবে ঢাকা থেকে শ্যামলী/মামুন/এনা বাস যায় সুনামগঞ্জ ভাড়া ৫০০-৫৫০ টাকা। সুনামগঞ্জ নেমে নতুন ব্রীজের পাড়ে মোটরবাইক দাঁড়িয়ে থাকে। কথা বলে বারেক টিলা নদীর পাড় পর্যন্ত ভাড়া নিবে ২০০ টাকা। একটাতে ২জন চড়া যায়। জাদুকাটা নদীর সামনে নামিয়ে দেবে। ৫ টাকা দিয়ে খেয়া অতিক্রম করে ওই পারে গেলেই বারেক টিলা, ওখান থেকে জাদুকাটা নদী দেখা যায়। বারেক টিলা থেকে নেমে চায়ের দোকান আছে কিছু। তাদের জিজ্ঞেস করলেই ছবির মত সুন্দর এই শিমুল ফুলের বাগান এ যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেবে। যাদুকাটা নদীর পাড়ের এই বাগান এখন পর্যটকদের বাড়তি বিনোদন দিচ্ছে। মাঘের শুরু থেকেই ওই বাগানের শিমুল গাছগুলো রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে। সারিবদ্ধভাবে লাগানো শিমুল গাছগুলো ফুলের পসরা সাজিয়েছে। যা কী না মনোমুগ্ধকর! পাপড়ি মেলে থাকা শিমুলের রক্তিম আভা আর শুবাস মন রাঙ্গিয়ে ঘুম ভাঙ্গায় সৌখিন হ্নদয়ে এ যেনো কল্পনার রঙ্গে সাজানো এক শিমুলের প্রান্তর। সেই সোন্দর্য উপভোগ করতে এই সময় দল বেঁধে হাজার হাজার পর্যটক ও দশনার্থীরা ছুঠে আসছেন। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার মানিগাঁঁও গ্রাম সংলগ্ন এই শিমুল বাগানটি অবসর কাটানোর আদর্শ জায়গা যেনো। এক পাশে শিমুল বাগান। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়। মাঝে চোখ জুড়ানো মায়াবী যাদুকাটা নদী। সব মিলে মিশে মানিগাঁও গ্রামটি অপরুপ এক কাব্যিক ভাবনার প্রান্তর। যদিও বাণিজ্যিক চিন্তা থেকেই যাদুকাটা নদীর পাড়ে গড়ে তৈরি করা শিমুল বাগান। বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে এই শিমুল বাগানে সারি সারি গাছের সবুজ পাতার সুনিবির ছায়ায় পর্যটকদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। আর বসন্তের ডালে ডালে ফুটে থাকা রক্ত মাখা লাল ফুলে আন্দোলিত করে পর্যটকদের মন। বর্ষা, বসন্ত কিংবা হেমন্ত। একের ঋতুতে এর এক এক রূপ
২.নীল রঙে রূপায়িত ”নীলাদ্রি”।
স্বর্গীয় সৌন্দর্যে ভরা জায়গাটা কাশ্মীর নয় আমাদের দেশেই ! কি অবাক হচ্ছেন ?স্বপ্নের সাম্পানের মতো এ যেন নীলের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার গল্প । হ্যা নীলাদ্রির কথা বলছি, ভাবছেন এটা আবার কি? ছবি দেখে কাশ্মীর ভেবে ভুল করবেন না,একে নীলাদ্রি নামেই চেনে সবাই। এর অবস্থান টেকেরঘাট, সুনামগঞ্জে। এর অপরূপ সৌন্দর্যে ডুব দিতে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে আসুন সুনামগঞ্জ থেকে। অনেকেই সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে যান। কিন্তুু এর আশেপাশেই অনেক সুন্দর সুন্দর নয়নাভিরাম জায়গা আছে যা যে কোনো পর্যটকের মনকে মুহূর্তেই দোলা দিয়ে যেতে পারে ! এমনই একটি জায়গা টেকেরঘাট চুনাপাথরের পরিত্যক্ত খনির লাইমস্টোন লেক। স্থানীয় লোকজন একে নীলাদ্রি লেক বলেই জানে ।এর নামটা যেমন সুন্দর এর রূপটাও তেমনি মোহনীয় । নিজ চোখে না দেখলে হয় বিশ্বাসই করতে পারবেন না পানির রঙ এতটা নীল আর প্রকৃতির এক মায়াবী রুপ। মাঝের টিলা গুলা আর ওপাড়ের পাহাড়ের নিচের অংশটুকু বাংলাদেশ এর শেষ সীমানা। বড় উচু পাহাড়টিতেই সীমানা কাটা তারের বেড়া দেওয়া আছে। এই লেকটি এক সময় চুনা পাথরের কারখানার কাচামাল চুনা পাথরের সাপ্লাই ভান্ডার ছিল যা এখন বিলীন

৩.পনাতীর্থঃ
হিন্দুধর্মের সাধক পুরুষ অদ্বৈত মহাপ্রভুর মা লাভা দেবীর গঙ্গা স্নানের খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শারীরিক সামর্থ্যের অভাবে ইচ্ছা পূরণের সম্ভাবনা ছিল না। অদ্বৈত মহাপ্রভূ তার মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য যোগসাধনা বলে পৃথিবীর সমস্ত তীর্থের প্ণ্যূ জল এক নদীতে এক ধারায় প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন। এই জলধারাই পুরনো রেনুকা নদী বর্তমানে যা যাদুকাটা নদী নামে প্রবাহিত। তাহিরপুর থানার এই নদীর তীরে পনাতীর্থে প্রতি বৎসর চৈত্র মাসে বারুণী মেলা হয়। এই মেলা বারুণীযোগ নামে স্থানীয় ভাবে পরিচিত। প্রতি বৎসর লাখো হিন্দু পূণ্যার্থীর সমাবেশ ঘটে এই বারুণী মেলায়। অনেক মুসলমানও এই মেলা দেখার জন্য পনাতীর্থ যান ।
৩.হাছন রাজা মিউজিয়াম:
সুনামগঞ্জ পৌরসভা এলাকার তেঘরিয়ায় সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে হাছন রাজার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি। (জন্ম ১৮৫৪ মৃত্যু ১৯২১ খ্রিঃ) এ বাড়িটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। হাছন রাজা মূলত ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত জমিদার। মরমী সাধক হাছন রাজা জীবনে অসংখ্য গান রচনা করে আজ অবধি লোকপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেছেন। কালোত্তীর্ণ এ সাধকের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতার ও গানের পা-ুলিপি আজও বহু দর্শনার্থীদের আবেগ আপ্লুত করে। এই মরমী কবির রচিত গানে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাছন রাজাকে পত্র মাধ্যমে অভিনন্দন ও প্রশংসা জানিয়েছিলেন। সুনামগঞ্জ পৌর এলাকাধীন গাজীর দরগা নামক পারিবারিক কবরস্থানে প্রিয়তম মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন মরমী কবি হাছন রাজা। হাছন রাজার মাজার দেখার জন্য প্রতি বৎসর বহু দর্শনার্থীর সমাগম হয়।
৪.ডলুরা শহীদদের সমাধি সৌধ:
যে স্থানটিতে গেলে মুহূর্তেই ৪৮ জন মহান শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় অন্তত চোখে ভাসে তার নাম ডলুরা। পাহাড়ের পাদদেশে চলতি নদীর তীরে লুকায়িত আছে সেই একাত্তরের রক্তত্যাগ সংগ্রামের স্মৃতি চিহ্ন। মুক্তিযুদ্ধে সুনামগঞ্জের ইতিহাস খুব সমৃদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধে সীমান্তবর্তী ডলুরা ছিল সুনামগঞ্জের অন্যতম রণাঙ্গন। এই রণাঙ্গনটি ছিল ৪ নং বালাট সেক্টরের অধীন। উক্ত রণাঙ্গনে সম্মুখসমরে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন তাদের কয়েকজনকে এখানে সমাহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে ৪৮ জন শহীদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ডলুরা শহীদ মাজার।
৫.টাঙ্গুয়ার হাওর
টাঙ্গুয়ারহাওর বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্রুপ জলমহালগুলোর অন্যতম।বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলাস্থিত জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওর বাংলাদেশের ২য় রামসার এলাকা। হিজল করচের দৃষ্টি নন্দন সারি এ হাওরকে করেছে মোহনীয় ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাংগুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। বর্তমানে মোট জলমহাল সংখ্যা ৫১টি এবং মোট আয়তন ৬,৯১২.২০ একর। তবে নলখাগড়া বন, হিজল করচ বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরটির আয়তন দাড়ায় প্রায় ২০,০০০ একর। টাংগুয়ার হাওর প্রকৃতির অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ। এ হাওর শুধু একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরণেরই স্থান নয়। এটি একটি মাদার ফিশারী। এ ছাড়াও নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলেঞ্চা, শতমূলি, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদি সহ দু’শ প্রজাতিরও বেশী গাছগাছালী রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে। জেলা প্রশাসনের কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বর্তমানে এ হাওরে রয়েছে ছোট বড় ১৪১ প্রজাতির ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ। নলখাগড়া বন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। শীত মৌসুমে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ব্যাপক পাখির আগমন ও অবস্থানে মুখরিত হয় টাঙ্গুয়ার হাওর
বর্ষাকালে সুনামগঞ্জ শহরের সাহেব বাড়ি নৌকা ঘাট থেকে ইঞ্জিন বোট বা স্পীড বোট যোগে সরাসরি টাঙ্গুয়া যাওয়া যায়। ইঞ্জিন বোটে ৫ ঘন্টায় এবং স্পীড বোটে ২ ঘন্টা সময় লাগে।
৭.লাউড়ের গড়:
প্রাচীন লাউর রাজ্যের স্মৃতি বহন করছে ভারত বাংলাদেশের সীমান্তের এই এলাকা। সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশে খুব কাছ থেকে দেখতে পারেন স্তরে স্তরে সাজানো পাহাড় শ্রেণী। খোলামেলা নিরিবিলি শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে স্বপরিবারে কিংবা দলবেধে পিকনিকে যাওয়ার জন্য এই এলাকা একটা সুন্দর স্থান।
৮.টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প:
চুনাপাথরের প্রাকৃতিক ভান্ডার রয়েছে টেকেরঘাটে। বিচিত্র উপায়ে চুনাপাথর সংগ্রহের পদ্ধতি সত্যিই বিস্ময়কর। সিমেন্ট শিল্পের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এই চুনাপাথরকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে গ্রামীণ আবহে পাহাড়ী খনি অঞ্চল। একদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের মধ্য থেকে চুনাপাথর সংগ্রহ প্রক্রিয়ার আধুনিক আয়োজন। আর এ পারে বাংলাদেশে বিশাল বিস্তৃত হাওর। দিগন্তে মেশা সবুজ ধানের মাঠ সত্যিই প্রকৃতির সাজানো এক মনোরম আঙ্গিনা। চুনাপাথর শিল্পকে ঘিরে টেকেরঘাটে সৃষ্টি হয়েছে ভিন্ন ধর্মী এক জীবন প্রণালী । সাধারনত প্রতি বছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চুনাপাথর সংগ্রহের কাজ চলে। চুনাপাথর সংগ্রহের কাজ বর্তমানে বন্ধ। টেকেরঘাটের বড়ছড়া হচ্ছে কয়লা আমদানির ব্যবসা কেন্দ্র। এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বড়ছড়াতে সৃষ্টি হয়েছে এক ভিন্ন ধারার জীবন পদ্ধতি। প্রতি বছর ভারত থেকে বৈধ উপায়ে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা আমদানি হচ্ছে এই শুল্ক ষ্টেশন দিয়ে।। ভারতের পাহাড়ী এলাকায় পাহাড়ী অধিবাসীদের কয়লা আহরণ পদ্ধতি, বিচিত্র জীবন ধারা আপনার জানার জন্য চমৎকার বিষয়। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আপনি দেখে আসতে পারেন পাহাড়ী অধিবাসীদের ভারতীয় ভূখন্ড। পাহাড়ী বন্ধুদের জীবন ধারা আপনাকে নাড়া দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
৯.গৌরারং জমিদার বাড়ী:
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অন্তর্গত গৌরারং ইউনিয়ন এর গৌরারং গ্রামে।গৌরারং জমিদার বংশের আদিপুরুষ নিধিরামের বর্তমান গৌরারং ইউনিয়ন পরিষদ অফিস সংলগ্ন প্রাচীন জমিদার বাড়ী রয়েছে। উক্তপ্রসাদে দেখার মত রংমহল, বাঁধাই করা প্রাচীন বিরাট পুকুরঘাট এবং জলবারান্দা, আন্ধকুপ, যাত্রামঞ্চ ইত্যাদি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে গন্য হয়।

এ বিভাগের অন্যান্য