অনন্ত অখণ্ড সময়ের খণ্ডিত হিসেবে বিদায় নিচ্ছে একটি বছর।

অনন্ত অখণ্ড সময়ের খণ্ডিত হিসেবে বিদায় নিচ্ছে একটি বছর। ২০১৭ সালের পর্দা নামবে আজ রাত ১২টায়। ১২টা ১ মিনিটে ২০১৮ সালের কাল গণনা শুরু হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ডায়েরিতে বিদায়ী বছরের প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির হিসাব যোগ হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে বিদায়ী বছরে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এ বছর ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বের দুর্নীতিমুক্ত সরকারপ্রধানদের তালিকায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের বুকে মানবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে বাংলাদেশ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির কারণে উন্নয়নের সাফল্য খানিকটা ¤øান হলেও অর্জনের পাল্লাই ভারী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে বছর শেষে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে বিশ্বব্যাপী অশান্তি এবং সংঘাতের বার্তা ছড়িয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

টানা দুই বছর ৭ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়সহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলা, নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে চলা, সামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রেও চলতি বছরে বাংলাদেশের বেশকিছু অগ্রগতি হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে, গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতেও অনেক কাজ হয়েছে।

৭ মার্চের ভাষণের বিশ্বস্বীকৃতি : বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের, মুক্তির সংগ্রামের ঐতিহাসিক ঘোষণা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণকে চলতি বছর বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। জাতির জনকের ভাষণকে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারের ‘ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

প্রশাসনে পদোন্নতির হিড়িক : বিদায়ী বছরে প্রশাসনে ছিল পদোন্নতির হিড়িক। স্থায়ী পদ না থাকায় প্রশাসনে আগে থেকেই বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা নিচের পদে কাজ করছিলেন। এমন ব্যবস্থায় নতুন করে যুক্ত হলেন এ বছরের পদোন্নতিপ্রাপ্তরা। যথারীতি চলতি বছরেও আলোর মুখ দেখেনি বহুল প্রতীক্ষিত সরকারি কর্মচারী আইনটি। একজন ইউএনওর বিরুদ্ধে মামলা করাসহ হয়রানির ঘটনা প্রশাসনে ব্যাপক আলোড়ন তোলে এ বছরই।

বিচার বিভাগ : নি¤œ আদালতের বিচারকের শৃঙ্খলাবিধি, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে বিদায়ী বছর সরগরম ছিল বিচারাঙ্গন। প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে বিদায়ী বছর ধরেই ছিল সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে টানাপড়েন। এই টানাপড়েনের জের ধরেই সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করেছেন।

সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের সংকটের সূচনা হয় নি¤œ আদালতের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি-মঞ্জুরিসহ নি¤œ আদালতের শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি নিয়ে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের আচরণ, বিচার করার অধিকার, এমনকি তাদের শাস্তি দেয়ার অধিকার জাতীয় সংসদকে দেয়া হয়। এ সংশোধনী বাতিল করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এ রায় এবং রায়ের যে পর্যবেক্ষণ অংশ তা নিয়ে সরকার মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হয়। বিচার বিভাগ নিয়ে এমন সংকট বাংলাদেশে অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি।

যুদ্ধাপরাধ বিচারে ধীরগতি : বছরজুড়ে বিচারাঙ্গন আলোচনায় থাকলেও বিদায়ী বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ধীরগতি ছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক বছরের মাঝামাঝিতে মারা যাওয়ার পর টানা তিন মাস ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ স্থবির ছিল। বছরের শেষ দিকে গত ১১ অক্টোবর বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামকে চেয়ারম্যান করা হলে কাজে ফেরে ট্রাইব্যুনাল।

ইসি পুনর্গঠন ও নির্বাচনের রোডম্যাপ : বিদায়ী বছরের শুরুতে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠিত হয়েছে। নতুন ইসি দায়িত্ব নেয়ার পর রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। গত আগস্ট মাসে আগামী নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর মতামত নিতে ইসি সংলাপের আয়োজন করে। ৪০টি নিবন্ধিত দল সংলাপে অংশ নেয়। এই সংলাপ সাফল্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এর আগে নির্বাচন কমিশন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করিয়েছে। বছর শেষে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও সুনাম কুড়িয়েছে স্বাধীন এ সংস্থাটি। এখন সবাই অপেক্ষায় রয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন কীভাবে পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন।

রোহিঙ্গা সংকট : বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে। তাদের দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও তারা রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে আসছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে ২০১৬ সাল থেকে। ২০১৭ সালে তারা ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। রোহিঙ্গাদের কারণে এখানকার আর্থসামাজিক জীবনে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, নতুন বছরের প্রথম মাসেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে শুরু করবে।

লাগামহীন নিত্যপণ্যের দাম : বিদায়ী বছরে নিত্যপণ্যের দাম ছিল লাগামহীন। বিশেষ করে চাল ও পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে উন্নতির ধারা বজায় থাকলেও লাগামহীন চালের বাজার আর ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলার কারণে বিদায়ী বছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশের পুরো সুযোগ নিতে পারেনি বাংলাদেশের অর্থনীতি।

পাহাড়ে ধস হাওরে বন্যা : বিদায়ী বছরে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। পাহাড় ধসে ১৬০ জনের মৃত্যু হয়। আর হাওরে অকাল বন্যায় লাখ লাখ একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। চলতি বছর ১১-১৩ জুনের ভারি বর্ষণে অন্তত ১৬০ জনের মৃত্যু হয় চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও মৌলভীবাজার জেলায়। পাহাড়ি ঢলে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়লে চট্টগ্রামের সঙ্গে রাঙামাটি ও বান্দরবানসহ কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। হাওরে আগাম বন্যার পর জুলাইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে মৌসুমের প্রথম বন্যায় ১৩টি জেলার অনেক উপজেলা প্লাবিত হয়। আগস্টের বন্যায় ৩২ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পৌনে ১ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিশৃঙ্খল ব্যাংক খাত : বিদায়ী বছরজুড়ে বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল ব্যাংকিং খাতে। বিশেষভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ সরকারের অনেক অর্জনকে ¤øান করে দিয়েছে। ব্যবসার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়া, পর্যবেক্ষক বসানো, পর্ষদ সভার যাবতীয় নথি বিশ্লেষণ, বড় ঋণ অনুমোদন, একক গ্রাহকের ঋণসীমা নির্ধারণ ও ঋণ পুনর্গঠন ব্যবস্থা চালুসহ বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েও ব্যাংক খাতকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

পারমাণবিক বিশ্বে বাংলাদেশ : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মযজ্ঞের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বিদায়ী বছরে পারমাণবিক বিশ্বে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। সরকারিভাবে প্রচারণায় এটিকে ‘পারমাণবিক’ শক্তিকেন্দ্র বলা হয়েছে।

সব মিলিয়ে উন্নয়নের মাপকাঠিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে। নতুন বছর দেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক সমাজ চায় ভালো একটি নির্বাচন, যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা বিতর্ক হবে না। সরকার, ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশনও পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করবে। নতুন বছরে এ প্রত্যাশা পুরো দেশবাসীর।

এ বিভাগের অন্যান্য