নতুন অভ্যাসে ৪৭% কলেরা নিয়ন্ত্রণ

সাবান পানিতে হাত ধুয়ে এবং বিশুদ্ধ পানি পান করে কলেরা রোগীর স্বজনদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ কলেরা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় এটা দেখা গেছে।

‘ছবি ৭’ নামের দিশারি প্রকল্পের আওতায় এই গবেষণা হয়েছে। গবেষণার আওতায় আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ঢাকা শহরের বিভিন্ন বস্তির কলেরা রোগীর স্বজনদের সাত দিন প্লাস্টিকের বোতলে রাখা সাবান গোলানো পানি দিয়ে হাত ধুতে হয়েছে এবং ঢাকনা দেওয়া প্লাস্টিকের বালতিতে নিরাপদ পানি রেখে তা পান করতে হয়েছে। নিয়মগুলো তাদের অভ্যাসে পরিণত করতে হয়েছে।

আইসিডিডিআরবির ইনফেকশাস ডিজিজেস বিভাগের মলিক্যুলার ইকোলজি অ্যান্ড মেটাজিনোমিকস ল্যাবরেটরির এই গবেষণা ‘রেনডমাইজড কনট্রোলড ট্রায়াল অব হসপিটাল-বেজড হাইজিন অ্যান্ড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট ইন্টারভেনশন (ছবি ৭) টু রিডিউস কলেরা’ শিরোনামে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের দি আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিনে ছাপা হয়। গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি সহায়তা করে। গবেষকেরা বলেছেন, আক্রান্ত হওয়ার সাত দিনের মধ্যে কলেরা রোগীর স্বজনদের কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি।

২০১৩ সালের জুন থেকে ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভর্তি হওয়া ১৬৫ জন কলেরা রোগীর ৪৪০ জন স্বজনকে গবেষণায় সম্পৃক্ত করা হয়। এদের অর্ধেককে প্লাস্টিকের ছোট খাওয়ার পানির বোতলের মুখ ছিদ্র করে তাতে ঘরে ব্যবহার করা ডিটারজেন্ট পাউডার বা সাবান গুলে রাখার নিয়ম শেখানো হয়। ঢাকনা দেওয়া বালতিতে ছিদ্র করে পানির ট্যাপ লাগিয়ে তাতে ফোটানো পানি রেখে পান করতে বলা হয়। লাল ও নীল রঙের প্লাস্টিকের বালতি, বোলসহ বিভিন্ন জিনিস কেনা বাবদ খরচ হয় পরিবারপ্রতি সর্বোচ্চ সাড়ে ৬০০ টাকা। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার সময় এসব সরঞ্জামসহ স্বজনদের তিন পাতা পানি বিশুদ্ধকরণ ক্লোরিন ট্যাবলেট দেওয়া হয়।

ট্যাবলেট শেষ হলে স্বাভাবিক নিয়মে পানি ফুটিয়ে ঢাকনা দেওয়া বালতিতে রাখার পদ্ধতি শেখানো হয়। শিখিয়ে দেওয়া নিয়মগুলো সাত দিন সঠিকভাবে পালন করতে বলা হয়। বাকি অর্ধেক রোগী ও তাদের শুধু যথানিয়মে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং তাদের স্বজনদের শুধু স্বাস্থ্যতথ্য দেওয়া হয়।

পরে এই দুই দলের স্বজনদের মধ্যে কলেরায় আক্রান্ত হওয়া ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও তুলনা করেছেন গবেষকেরা। তাতে দেখা গেছে, যারা সাবান পানি ও নিরাপদ পানি ব্যবহার করেছে, তাদের মধ্যে কলেরার প্রকোপ ৪৭ শতাংশ কম।

এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মূনীরুল আলম বলেন, ফলাফল নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকেরা উৎসাহ দেখিয়েছেন। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্লাস্টিকের ঢাকনাযুক্ত বালতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। একজন প্রশিক্ষিত ব্যক্তি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা রোগী ও স্বজনদের হাত ধোয়ার নিয়ম, পানি বিশুদ্ধ করা এবং তা সংরক্ষণের নিয়ম শিখিয়ে দিতে পারেন। এটি অভ্যাসে পরিণত হলে কলেরাসহ অন্য পানিবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হবে। তখন তা ‘সামাজিক ভ্যাকসিন’ হিসেবে কাজ করবে।

গত বুধবার মহাখালীর দক্ষিণ পাড়া বস্তিতে গিয়ে কথা হয় বিউটি বেগমের সঙ্গে। বিউটি গবেষণায় যুক্ত আছেন। বিউটির ছোট ঘরে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে আছে ঢাকনা দেওয়া বালতিতে ফুটানো পানি। দরজার পাশেই আরেকটি হাত ধোয়ার জন্য পানির কল লাগানো বালতি। ছোট প্লাস্টিকের টুলে রাখা এ বালতির নিচে একটি বোল রাখা। আর পাশেই বোতলে সাবান পানি রাখা। টয়লেটের সামনে দড়িতে ঝোলানো সাবান পানির বোতল।

এক মাস আগে কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার পর বিউটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বিউটি বলেন, ‘কলেরা হওয়ার আগেও পানি ফুটাইয়্যা কলসিতে রাইখ্যা খাইতাম। পানি ঢাইক্যা রাখতাম না। সাবান দিয়া নিয়ম কইরা হাতও ধুইতাম না। এখন তো বোতলে রাখা সাবান পানি দিয়া বস্তির সবাই হাত ধুইতেই থাকে।’

এ বিভাগের অন্যান্য