ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি মামলার চার্জশিট এ মাসেই: পিকে হালদারসহ আসামি ২৫

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্য দিয়ে গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারসহ নানামুখী তদন্ত শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা। যেটি ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযান হিসেবে পরিচিত।

সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) অভিযানের সূত্রপাত করলেও পরে তালিকাভুক্ত ও গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে তদন্তে যুক্ত হয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি)।

১ বছর আগে শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেললেও প্রথম দিকে যে তালিকা হয় এবং যাদের গ্রেফতার করা হয় তাদের কেউ ছাড়া পায়নি।

১ বছরে এ তিন সংস্থার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুদক ১১৮ জনের যে তালিকা করেছিল ওই তালিকায় নাম আসা যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা সম্রাট, জিকে শামীম, খালেদ এবং আর্থিক ও বিনিয়োগ খাত থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচারে সংশ্লিষ্ট প্রশান্ত কুমার হালদারসহ (পিকে হালদার) ২৫ প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হচ্ছে এ মাসেই।

তাদের বিরুদ্ধে করা ২২ মামলার তদন্ত শেষ করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে সম্পদের মামলা আদালতেও পাঠাতে চায় দুদক।

এ ২২ মামলায় যুক্ত ২৫ প্রভাবশালীর ৬৫৫ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করেছে দুদক। তদন্তে ২৫ জনের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ক্যাসিনোসংশ্লিষ্টতায় যাদের তালিকা দুদকের হাতে রয়েছে সবার বিরুদ্ধে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় তদন্ত শেষ করতে চায় কমিশন। কারও মুখ দেখে তদন্ত হবে না।

অপরাধ-দুর্নীতির মেরিট (গুরুত্ব) দেখে মামলা ও চার্জশিট হচ্ছে। সূত্র জানায়, ২৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট ছাড়াও তালিকাভুক্ত আরও অন্তত ১৭ জনের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শেষ করে এনেছে দুদক।

তাদের বিরুদ্ধেও প্রস্তুত হচ্ছে মামলা। দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন ক্যাসিনো তালিকাভুক্ত হাইপ্রোফাইলদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান ও তদন্ত তদারক করছেন।

যুবলীগ নেতা ও ব্যবসায়ী জিকে শামীমের বিরুদ্ধে গত বছর ২১ অক্টোবর অবৈধ সম্পদের প্রথম মামলাটি করে দুদক। মামলায় তার মা আয়েশা আক্তারকেও আসামি করা হয়। এতে জিকে শামীমের ১৯ ব্যাংকের হিসাবে ৩২৪ কোটি ৫৬ লাখ ৩৮ হাজার ৭৩৫ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে।

আদালতের নির্দেশে এ টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে। ৪০ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার ২০০ টাকার স্থাবর সম্পদ ক্রোক করা হয়। জিকে শামীমের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় চার্জশিট হয়েছে।

দুদকের ক্যাসিনো দুর্নীতির মামলায় চার্জশিট তালিকায় লিজিং কোম্পানি ও আর্থিক খাত থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচারে জড়িত প্রশান্ত কুমার হালদারের নাম রয়েছে ২০ নম্বরে। ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টতায় তার বিরুদ্ধে ৮ জানুয়ারি মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন।

মামলায় তার বাসার ঠিকানা উল্লেখ করা হয় ৫/১ ধানমণ্ডি। মামলায় উল্লেখ করা তার ৫৮টি ব্যাংক হিসাব এবং ১৭টি কোম্পানির শেয়ার হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। এছাড়া ১৩০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে।

ক্যাসিনো তালিকাভুক্ত সাবেক যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক (বর্তমানে বহিষ্কৃত) মো. খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে অভিযান শুরুর প্রথম দিনই ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে গুলশানের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

তার বিরুদ্ধে প্রথমে অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা করে র‌্যাব। পরে ২১ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের মামলাটি দেয় দুদক।

মামলায় উল্লেখ করা তার ৬টি ব্যাংকের ১৭টি হিসাবে ৩১ কোটি ৫৬ লাখ ৫৮ হাজার ৭৮৫ টাকার অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ করা হয়েছে। এ ছাড়া গুলশানে ৩ কোটি টাকা মূল্যের ৩৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ক্রোক করা হয় বলে দুদক সূত্র জানায়।

যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছর ১২ ডিসেম্বর মামলা করে দুদক। এর আগে র‌্যাব তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা করেছিল।

দুদকের মামলায় সম্রাটের ২টি ব্যাংকের ২টি হিসাবে ৮৮ লাখ ৭৪ হাজার ১৮ টাকার তথ্য দেয়া হয়। তার এ টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে। তদন্তে তার আরও অন্তত ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে একটি সূত্র জানায়।

যেদিন সম্রাটের বিরুদ্ধে মামলা দেয় দুদক একই দিন তার সহযোগী যুবলীগ দক্ষিণের সহ-সভাপতি (বহিষ্কৃত) এনামুল হক আরমানের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের মামলা করে দুদক। আদালতের নির্দেশে তার এ টাকার অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ করা হয়েছে।

অনলাইন ক্যাসিনোর মাস্টার মাইন্ড সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে গত বছর ২৭ অক্টোবর অবৈধ সম্পদের মামলা করে দুদক। মামলায় দেশের সরকারি ও বেসরকারি ১০টি ব্যাংকের ২৬টি শাখায় তার ৫৪ লাখ ৫০ হাজার ১৩৬ টাকা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

তার ৫৪ লাখ ৫০ হাজার ১৩৬ টাকার অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ করা হয়েছে। একইদিন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক ও বিসিবির পরিচালক মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে সম্পদের মামলা দেয় দুদক।

এতে দেশের ৭টি ব্যাংকের ১৭টি হিসাবে তার ২ কোটি ৯৬ লাখ ২৮ হাজার ৯৮৪ টাকা এবং ২টি গাড়িসহ ১ কোটি ৬১ লাখ টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য দেয়া হয়। আদালতের আদেশে তার এ টাকার অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ করা হয়েছে।

২৩ অক্টেবর আওয়ামী লীগ নেতা রুপন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের মামলা হয়। মামলায় তার নামে দেশের বেসরকারি ৬টি ব্যাংকের ৩৫টি হিসাবে ৮ কোটি ৭৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকার তথ্য দেয়া হয়।

এছাড়া ৬ কোটি টাকার অবৈধ স্থাবর সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তার ৮ কোটি ৭৩ লাখ ৯৭ হাজার ১০১ টাকার অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ করা হয়েছে। ওই দিন তার ভাই এনামুল হক এনুর বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদের মামলা করে দুদক।

এতে দেশের সরকারি ও বেসরকারি ৬টি ব্যাংকের ৩১টি হিসাবে ১০ কোটি ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৩৬৫ টাকা ও ৩ কোটি ১২ লাখ টাকার অবৈধ স্থাবর সম্পদের তথ্য দেয়া হয়। এ টাকার সম্পদ ফ্রিজ করা আছে।

ক্যাসিনো তালিকার ৭ নম্বরে থাকা যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর সম্পাদক (বহিষ্কৃত) কাজী আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে ২৯ অক্টোবর মামলা করে দুদক।

অবৈধ সম্পদের মামলায় উল্লেখ করা হয়- ১০টি ব্যাংকের ৫১টি হিসাবে তার ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৬৭ হাজার ৪৯৯ টাকা, ১টি দোকান, ২৪.৫০ শতাংশ জমি, প্রায় তিন সাড়ে চার কোটি টাকা মূল্যের ৩টি ফ্ল্যাট রয়েছে।

আদালতের আদেশে তার ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৬৭ হাজার ৪৯৯ টাকার অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ করা হয়েছে। কাজী আনিসুর রহমানের স্ত্রী সুমি রহমানের বিরুদ্ধেও পৃথক একটি অবৈধ সম্পদের মামলা করে দুদক।

এতে অস্থাবর সম্পদের তথ্য দেয়া হয়নি। তবে তার নামে ঢাকার শুক্রাবাদে ৩৪০০ বর্গফুটের চার তলা বাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়। যার মূল্য আনুমানিক ৫ কোটি টাকা। তার এ বাড়িটি ক্রোক করা হয়েছে।

গত বছর ৩০ অক্টোবর কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি যুবলীগ নেতা (বহিষ্কৃত) মোহাম্মদ শফিকুল আলম ফিরোজের ১ কোটি ২৭ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ও ১ কোটি ৪০ লাখ ৪৩ হাজার টাকার অবৈধ স্থাবর সম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমানের (পাগলা মিজান) বিরুদ্ধে গত বছর ৬ নভেম্বর ২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও ৭টি ব্যাংকের ৪২টি হিসাবে ১ কোটি ৬৮ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদের (ক্যাশ টাকা) তথ্য দেয়া হয়।

এ সম্পদ জব্দ করা হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর একেএম মমিনুল হক সাঈদের ৪টি ব্যাংকের ৭টি হিসাবে ৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা ক্রোক ও জব্দ করা হয়।

ঢাকা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের বিরুদ্ধে ৬ নভেম্বর ১২ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ ও ১ কোটি ১২ লাখ ৩১ হাজার টাকার অস্থাবর (ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ) সম্পদ জব্দ করা হয়।

যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য মো. জাকির হোসেনের ৬টি ব্যাংক হিসাবে ৪ কোটি ৬৪ লাখ ৮ হাজার টাকাসহ ৫ কোটি ২১ লাখ ২২ হাজার টাকা ফ্রিজ করা হয়। এছাড়া ২৭ লাখ ৮১ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়।

জাকির হোসেনের স্ত্রী আয়েশা আকতার সোমার নামে ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ ও ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৬২ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদের মামলা হয় ১৭ ডিসেম্বর। তার ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে।

তালিকায় নাম থাকা গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রিজার্ভ) উৎপল কুমার দের ৬ কোটি ৬২ লাখ ৬৮ হাজার ৭৫৪ টাকার জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ ও ১ কোটি ১৮ লাখ ১৭ হাজার ৯০৩ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়।

তার ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে। এছাড়া তার স্ত্রী লোপা দের ৫ কোটি ১২ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ করা হয়েছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রধান মো. মুমিতুর রহমান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে করা দুদকের মামলায় বিভিন্ন ব্যাংকে স্বামী-স্ত্রীর নামে ২ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৫৩২ টাকা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তার এ টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে।

মামলায় তার স্ত্রীসহ দু’জনের নামে ২ কোটি ৫০ লাখ ১৬ হাজার টাকার অবৈধ স্থাবর সম্পদের তথ্যও দেয়া হয়। এছাড়া ক্যাসিনো তালিকার গণপূর্তের ঠিকাদার মো. শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৭ কোটি ১২ লাখ টাকার স্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়। এ সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে।

এ বিভাগের অন্যান্য