লিবিয়ায় মানব পাচার: বন্দিশালায় আরও ২৮ বাংলাদেশি

লিবিয়ায় পাচার হওয়া আরও কয়েকজন বাংলাদেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। পাচারচক্রের হোতা বাংলাদেশের মনির হাওলাদারের বন্দিশালায় ২৮ জন বাংলাদেশি রয়েছেন।

তারা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। লিবিয়ার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে মনিরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে মনির অভিবাসন প্রত্যাশীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোয় যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য বাদশার মাধ্যমে ১৭ জনকে মুক্ত করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বুধবার মনির হাওলাদার ওরফে মনির হোসেন (২৬) এবং মো. সেলিম ওরফে সেলিম শিকদারকে (৩৬) গ্রেফতার করেছে ডিবি। বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়।

আদালত তাদের সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গ্রেফতারের পর মানব পাচারের বিষয়ে মনির ও সেলিম চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন বলে ডিবি সূত্রে জানা গেছে। এদিকে মনিরের দাবি, তার বন্দিশালায় ২৮-৩০ নয়, এখন ১৬ জন বাংলাদেশি অবস্থান করছেন।

গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা অতিরিক্ত টাকার জন্য বন্দিশালায় জিম্মি ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ জনকে গুলি করে হত্যা করে। আরও ১১ বাংলাদেশি আহত হন।

এ ঘটনায় মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় ৩০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ইতোমধ্যে ৭১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সর্বশেষ সেলিম ও মনিরকে গ্রেফতার করা হয়।

৬ জুন মতিঝিল থানায় করা মামলায় বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে ডিবি। এ মামলার এক ও দুই নম্বর আসামি তারা।

আরও ২৫ জন আসামি রয়েছে। ডিবি সূত্র জানায়, সেলিম ও মনির অন্য সহযোগীদের সহযোগিতায় শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফেনী, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সহজসরল লোকজনকে টার্গেট করে।

মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তারা লিবিয়ায় যেতে লোকজনদের আগ্রহী করে তুলে। পাসপোর্ট ও ছবিসহ ঢাকার দালাল শরীফ ও কবিরের কাছে তারা লোকদের পাঠিয়ে দিত।

পাচার হওয়া লোকদের অভিভাবকদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে টাকা সংগ্রহ করে মনিরের স্ত্রী, শ্বশুর অথবা বাবার কাছে রাখত। একটি অংশ দালাল শরীফ ও কবিরের কাছে অথবা অ্যাকাউন্টে পাঠানো হতো। এ কাজের জন্য সেলিম নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন পেত।

সূত্র জানায়, মানব পাচার চক্রের অন্যতম মূলহোতা মনির অল্পবয়সী। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও অত্যন্ত চতুর প্রকৃতির এবং তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন। অল্প সময়ের মধ্যে লিবিয়ার মিলিশিয়া, সেনাবাহিনী এবং লোকাল পুলিশের সঙ্গে অবৈধ সখ্য গড়ে তোলে।

তাদের সহযোগিতায় বেনগাজীর মাঝুরি, ত্রিপলির সুলেমান এবং জোয়ারার গেইমিং ক্যাম্প মনির পরিচালনা করে। ২০১০ সালে মনির প্রথম তার আত্মীয় শাহজালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় যায়।

এরপর ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে দালাল শরীফ ও কবিরের মাধ্যমে মনির লিবিয়ায় যায়। মনির লিবিয়ায় প্রথমে একটি কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ নেয়।

পরে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি চার লাখ টাকার বিনিময়ে দালাল শরীফ ও কবিরদের পরিচালিত স্বাধীন ট্রাভেলসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শতাধিক লোককে লিবিয়ায় নিয়ে যায়।

ডিবির উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান যুগান্তরকে জানান, বাংলাদেশ থেকে দুবাই হয়ে লোকজন বেনগাজিতে পৌঁছার পর প্রথম দফায় দালাল শরীফের বন্দিশালা, দ্বিতীয় দফায় বাদশাহ ও মনিরের মাঝুরী বন্দিশালা এবং তৃতীয় দফায় ত্রিপলিতে মনিরের সুলেমান বন্দিশালায় আটক রাখে।

এরপর আটকদের আত্মীয়স্বজনের কাছে চুক্তির টাকাসহ অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে। টাকার দাবিতে বন্দিদের প্রচণ্ড মারধর করা হয়। মারধরের ভিডিও ধারণ ও কান্নার শব্দ মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে তা আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠায় এবং মোবাইল ফোনে কান্নার শব্দ শোনায়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, মনির লিবিয়ার জোয়ারাতে একটি গেমিং ক্যাম্প পরিচালনা করে আসছে। সেখানে নিজের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন দালালদের মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে লিবিয়ায় যাওয়া বাংলাদেশিদের কাছ থেকে জনপ্রতি কমপক্ষে দুই লাখ টাকা করে নেয়।

এর বিনিময়ে লিবিয়ার কোস্টগার্ড, মিলিশিয়া, সেনাবাহিনী ও পুলিশের (আ. গাফ্ফার, সোহেল, মুসা) ছত্রছায়ায় অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালিতে পাঠায়। বেশির ভাগ সময় সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশের কোস্টগার্ডের হাতে আটক হয়ে তাদের কারাবরণ করতে হয়।

ডিবির ডিসি মশিউর রহমান আরও জানান, গ্রেফতার মনিরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে লিবিয়ায় একাধিক ক্যাম্পে তার নিজস্ব লোকজনের হেফাজতে আরও বেশকিছু বাংলাদেশি প্রতারিত হয়ে বন্দি অবস্থায় আছেন।

ইতোমধ্যে অন্য মামলায় বাদশাহর মাধ্যমে যোগাযোগ করে কমপক্ষে ১৭ জন বাংলাদেশিকে মুক্ত করা হয়েছে। তারা ফিরে পেয়েছে তাদের পাসপোর্ট ও পকেট মানি। লিবিয়ার মানব পাচার সংক্রান্ত সার্বিক বিষয় পুলিশ সদর দফতর থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

ঢাকায় লিবিয়ার নাগরিকসহ গ্রেফতার ৬ : রাজধানীর হাতিরঝিল ও পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে লিবীয় নাগরিক সামির আহমেদ ফরাজ (৪৫) ও রিক্রুটিং এজেন্সি সুফি ইন্টারন্যাশনালের মালিক হাজী আবদুল গোফরানসহ (৬০) ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বুধবার রাতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব-৩ এর একটি দল এবং জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) যৌথ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- মিজানুর রহমান (৩৪), নজরুল ইসলাম (৪২), মহিন উদ্দিন (৩১) ও মোহাম্মদ সোহেল (৩৪)।

র‌্যাব জানায়, লিবীয় নাগরিক সামিরকে হাতিরঝিল এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে দুটি মোবাইল ফোন, দুটি সিমকার্ড, একটি হাতঘড়ি এবং নগদ ৮০০ টাকা জব্দ করা হয়। পল্টনে সুফি ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে হাজী গোফরানসহ অন্যদের গ্রেফতার করা হয়।

সেখান থেকে ছয়টি পাসপোর্ট, নয়টি চেকবই, ছয়টি মোবাইল সেট, হোটেল সোনারগাঁওয়ের আটটি বিল ভাউচার, পাঁচটি বিভিন্ন রেজিস্টার্ড বই, ৩৩টি পাসপোর্টের স্ক্যানকপি, ৩৯টি পাসপোর্টের ফটোকপি জব্দ করা হয়।

র‌্যাব জানায়, লিবিয়ার নাগরিক সামির টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে আসেন। এক বছর ধরে সামির সোনারগাঁওয়ে অবস্থান করছেন।

তার সব খরচ বহন করতেন সুফি ইন্টারন্যাশনালের মালিক গোফরান। তার ভিসার মেয়াদ ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়ে যায়। গোফরানের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার এখলাছপুরে।

এ বিভাগের অন্যান্য