সিলেট-ঢাকা রেলপথে আতঙ্ক!

জুনেদ আহমেদ চৌধুরী :: দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় মানুষের আস্থার কেন্দ্রবিন্দু ছিল একসময় ট্রেন সার্ভিস। কিন্তু সিলেট-ঢাকা রেলপথ এখন মানুষের কাছে যেন এক আতঙ্কের নাম। এই লাইন এখন মানুষের কাছে পরিণত হয়েছে মরণ ফাঁদে। গত পাঁচ মাসে সিলেট-ঢাকা ট্রেন লাইনে দশটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় পাঁচ জন নিহত ও প্রায় শতাধিক আহত হয়েছেন।

বার বার দুর্ঘটনার কারণে যাত্রী কমেছে অর্ধেকের কাছাকাছি। তবে সিলেটের স্টেশন ম্যানেজার দাবি করেন, যাত্রী আরো বেড়েছে।

এদিকে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। যার কারণে, সংশ্লিষ্টদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

জানা গেছে, ট্রেনের কুলাউড়া এরিয়ার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (পরিবহণ) নুরুল ইসলামকে সম্প্রতী শোকজ করা হয়েছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে না পারায়। কয়টি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, তার মনে নেই। কুলাউড়ায় বার বার দুর্ঘটনার বিষয়েও তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেল বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রেল লাইনের উন্নয়নের জন্য যে বাজেট দরকার সরকার সেটা দিচ্ছেনা। যার কারণে বার বার বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে রেল লাইনে ।

ত্রুটিপূর্ণ রেলপথ: সিলেট থেকে ঢাকার রেল পথের দুরত্ব ১৭৬ কি. মি.। ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল এই লাইন। জোড়াতালি দিয়ে এখনো চলছে দেশের অন্যতম এই রেলপথ। রেল লাইন ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ জায়গায় নেই স্লিপার, নাট-বল্টু। আবার কোথাও কোথাও নাট-বল্টু ঢিলে থাকায় রেল লাইন নড়বড়ে হয়ে আছে। রেল লাইনের পাশে বসবাস করা অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জরাজীর্ণ রেল লাইনের ছবি ও ভিডিও আপলোড করায় জনমনে সৃষ্টি হয়েছে ভীতির। বেশিরভাগ জায়গায় নেই পরিমাণমত পাথর।

রেলের স্লিপার ভরে পাথর থাকার কথা থাকলেও তা নেই বলে স্বীকার করেছেন সিলেট জোনের প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম খান। তবে তিনি বলেন, মেরামতের জন্য কাজ চলমান রয়েছে। পুরাতন নাট-বল্টুও লাগানো হচ্ছে। সিলেট-ঢাকা রেল লাইনের ঝুঁকিপূর্ণ ৪৩, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর ব্রিজের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে তিনি জানান।

যে দশটি দুর্ঘটনা: গত ৪ মাসে সিলেট-ঢাকা রেল লাইনে ১০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এক মাসের ভিতরে শুধু মৌলভিবাজারের কুলাউড়ায় ঘটেছে ৫টি দুর্ঘটনা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের এক কর্মকর্তা দাবি করেন, পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় কুলাউড়ায় বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে যাত্রীরা এ কথা মানতে নারাজ। যাত্রীরা মনে করেন, পুরাতন ইঞ্জিন, বগি ও বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার জন্য এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।

সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাও রেলস্টেশনে একটি ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয় ।ঐ দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মাইজগাও স্টেশন ছাড়ার পর এ লাইতচ্যুতির ঘটনা ঘটে। একটি বগির চারটি চাকা লাইন থেকে সরে যাওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। লাইনে সমস্যা থাকার কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে ষ্টেশন মাস্টার সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন ।

৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী জালালাবাদ এক্সপ্রেস আবারও ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাও এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয়। সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে এ ঘটনা ঘটে।

এর আগে গত ১৬ আগস্ট যাত্রীবাহী উপবন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পতিত হয় ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা হিসেবে চিহ্নিত ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাও এলাকায়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে এই ট্রেনের একটি বগির চারটি চাকা লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে যাত্রী সাধারন চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে ১৫/২০ জন যাত্রী আহত হন।

১৯ ও ২০ জুলাই কুলাউড়া জংশন এলাকায় দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯ জুলাই সকালে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি কুলাউড়া জংশনের ৩শ ফুট দূরে একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে কয়েকজন যাত্রী আহত হন। পরে দুর্ঘটনায় পড়া ওই বগি রেখেই ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় ট্রেনটি।

পরদিন ২০ জুলাই সিলেট থেকে ছেড়ে যাওয়া ঢাকাগামী আন্তঃনগর কালনী এক্সপেস ট্রেনটি একই স্থানে দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে সারা দেশের সাথে সিলেটের আড়াই ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে।

গত ৭ জুলাই ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি কুলাউড়ার হাজিপুরের পলকি ও মনু ব্রিজের মধ্যখানে একটি গরুকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থলে গরুটি মারা যায়। এতে ইঞ্জিনের সামনের একটি হুইস পাইপ ভেঙ্গে ঘটনাস্থলে ট্রেনটি থেমে যায়। বিকল হয় ইঞ্জিন।

এর আগে গত ২৮ জুন অতিবৃষ্টির কারণে ও পাহাড়ি ঢলে সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস বড়ছড়া ব্রিজ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আটকা পড়ে। প্রকৌশলীরা আসার পর ট্রেনটি চলাচল করে।

২৩ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায় ঘটে বড় ধরণের দুর্ঘটনা। এ ঘটনায় ৫ জন নিহত ও ৬৭ জনের মতো যাত্রী আহত হন। সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি একটি ব্রিজ ভেঙ্গে পেছনের ৫টি বগি উল্টে যায়। ২১ ঘণ্টা পর রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়। পরের দিন রেল মন্ত্রী সিলেট এসে দাবি করেন, অতিরিক্ত যাত্রির কারণে ঐ দুর্ঘটনা ঘটে। ঐ ঘটনায় ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল ।

এছাড়া ২ জুন হবিগঞ্জের বাহুবলের রশিদপুরে কুশিয়ারা ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। ১৬ ঘণ্টা পর সারা দেশের সাথে সিলেটের ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।

ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজগুলি: সিলেট-ঢাকা রেল লাইনে ৬টি ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ রয়েছে বলে জানা গেছে। হবিগঞ্জের শাহজিবাজারের ৭৩ নম্বর সেতু, লস্করপুরের ১০২ নম্বর সেতু, বাহুবলের রশিদপুরের ১১৪ নম্বর সেতু, শায়েস্তাগঞ্জের ১০৫ নম্বর সেতু, কমলগঞ্জের ভানুগাছের ১৮৩ নম্বর সেতু, ফেঞ্চুগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর উপরের সেতু ও ছাতকের ৩২ নম্বর সেতু বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

ডুয়েল গেজ বাস্তবায়ন কবে?
ঢাকা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রয়েছে ডুয়েল গেজ লাইন। কিন্তু আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত লাইন রয়েছে ব্রিটিশ আমলের রেল লাইন। বর্তমান সরকার এই লাইন ডুয়েল গেজে রূপান্তরিত করার জন্য একনেকে ১৬ হাজার ১৪৪ লাখ টাকার প্রকল্প পাস করেছে।

আন্দোলনে যাচ্ছে সিলেটবাসী: নিরাপদ সড়ক চাই সিলেট জেলা শাখার সভাপতি এম বাবর লস্কর বলেন, সড়ক ও রেল লাইন এখন কোন অবস্থায় নিরাপদ নয়। ডুয়েল গেজ লাইন বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা বিভিন্ন কর্মসূচীতে যাচ্ছি। তিনি জানান, ইতোমধ্যে রেল সপ্তাহ পালনের সময় তাদের সাথে আমরা কথা বলেছি।

পুরাতন ট্রেনও দুর্ঘটনার কারণ: সিলেট-ঢাকা রেল লাইনে জরাজীর্ণ স্লিপার, রেলের পুরাতন ব্রিজ, রেল লাইনই শুধু দুর্ঘটনার জন্য দায়ী নয় বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী। তিনি বলেন, পুরাতন ট্রেন গুলোতেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে ।

এ বিভাগের অন্যান্য