আচরণবিধি লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ, নেই ব্যবস্থা ডাকসু নির্বাচন

শুরু হয়ে গেছে কাউন্টডাউন। চলছে জোর প্রচার। আগামী সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচন। তবে নির্বাচনী প্রচারে ‘আচরণবিধি’র ধার ধারছেন না কোনো প্যানেলের প্রার্থীই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার আচরণবিধি মেনে চলার অনুরোধ করা হলেও কেউ কর্ণপাত করছেন না তাতে। এ নিয়ে ‘লিখিত অভিযোগ’ দিতে বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকছে প্রশাসন। ফলে অনেকটাই ‘কাগুজে আচরণবিধি’তে পরিণত হয়েছে তা। এর জন্য প্রশাসনকেই দায়ী করেছেন অনেকে। ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধিমালার ১৫(ক) ধারায় বলা আছে, ‘নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে সংশ্নিষ্ট রিটার্নিং অফিসার লিখিত অভিযোগ প্রাপ্তি ও তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ ছাড়া সংশ্নিষ্ট রিটার্নিং অফিসার প্রয়োজন বোধে স্বপ্রণোদিতভাবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।’

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আচরণবিধিতে প্রশাসনের স্বপ্রণোদিতভাবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একটিও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। প্রার্থীরা এখন বিষয়টি স্বাভাবিক ভেবে নিয়েছেন।

আচরণবিধির ১৫(খ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে কেউ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা, প্রার্থিতা বাতিল অথবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার অথবা রাষ্ট্রীয়/বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী অন্য যে কোনো দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

সরেজমিন ক্যাম্পাসে দেখা গেছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচার করতে গিয়ে আচরণবিধি মানছেন না কেউই। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদসহ স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও উঠেছে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ।

আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দেয়ালে ছাত্রলীগের প্যানেলের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চেয়ে পোস্টার লাগানো হয়। এ ছাড়া চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগে রঙিন স্টিকার দেয়ালে সাঁটানো, হলে হলে নির্বাচনী সভায় রঙিন ব্যানারের ব্যবহার, শ্রেণিকক্ষ ও পাঠকক্ষে প্রচার চালানো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরোধী পক্ষকে আক্রমণ করে বক্তব্য প্রদান, নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ব্যবহার করাসহ একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ছাত্রলীগ। অন্যদিকে, আচরণবিধি ভঙ্গ করে ছাত্রদলের প্রচারে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার, সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী অংশ নেন- যারা ভোটার নন। ছাত্রত্ব না থাকাসহ তাদের সবার বয়স ৩০ বছরের বেশি। এ ছাড়া প্রচারে মোটরসাইকেলের শোডাউন দেখা যায়, যা আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এদিকে, গত মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে ‘ব্যান্ড পার্টিসহ’ শোভাযাত্রা বের করেন বাম জোটের প্রার্থীরা। শোভাযাত্রায় জোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দীসহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রার্থীরাও ছিলেন। এ ছাড়া ডাকসু নির্বাচনে যারা ভোটার বা প্রার্থী নন, এমন বহিরাগতদেরও দেখা যায়। একই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পক্ষে প্রচার চালাতে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনকে দেখা যায়- যা আচরণবিধির লঙ্ঘন। তিনি ডাকসুর ভোটার বা প্রার্থী কোনোটিই নন। এ ছাড়া বেশ কয়েজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও নানাভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করতে দেখা যাচ্ছে।

এ বিষয়ে সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমিদুর রহমান ইমন বলেন, আমরা চাই শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন হোক। প্রচার থেকে ভোট গ্রহণ পর্যন্ত শৃঙ্খলা বজায় থাকুক। এ বিষয়ে প্রশাসনকেই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। তিনি বলেন, ব্যানার, পোস্টার লাগানোর ব্যাপারে কোনো ত্রুটি থাকলে প্রশাসন লিখিতভাবে অভিযোগ গ্রহণ করে পদক্ষেপ নেবে। তবে এর বাইরেও যদি কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকে, তাহলে সে বিষয়টিও প্রশাসনকে দেখতে হবে।

ছাত্র ফেডারেশন থেকে জিএস প্রার্থী উম্মে হাবিবা বেনজির বলেন, প্রচার শুরু হওয়ার আগে থেকেই আমরা রঙিন পোস্টার লাগানো ও ব্যানার টানানোর মাধ্যমে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি দেখে আসছি। অথচ আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, প্রশাসন চাইলে স্বপ্রণোদিত হয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে সেটা করা হচ্ছে না। নির্বাচনের পরিবেশ-পরিস্থিতি সবকিছু দেখলে বোঝা যায়, একটি দলকে জেতানোর জন্য একতরফাভাবে প্রশাসনের প্রচেষ্টা স্পষ্ট।

এ বিষয়ে জানতে নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. এস এম মাহফুজুর রহমানকে গতকাল মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব। তবে এ পর্যন্ত সাংবাদিক বাদে কোনো প্রার্থী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে জানায়নি। একটি অভিযোগ এসেছিল। তবে প্রমাণ না থাকায় আমরা ব্যবস্থা নিতে পারিনি। স্বপ্রণোদিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে রঙিন পোস্টারের ব্যাপারে যে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো অপসারণ করা হয়েছে। তবে কাউকে হাতেনাতে ধরা যায়নি বলে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। প্রার্থীদের পক্ষেই আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে, প্রার্থীদের কিছু বলা হচ্ছে কি-না- জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, এ বিষয়ে কথা বলে তাদের সতর্ক করেছি।

ভোট গ্রহণের সময় নিয়ে প্রশ্ন :১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচনে ভোট প্রদানের সময় নিয়ে বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মাত্র ৬ ঘণ্টায় ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর ভোট গ্রহণ সম্ভব নয়। প্রত্যেক ভোটারকে ৩৮টি করে ভোট দিতে হবে। ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর প্রত্যেকে এই স্বল্প সময়ে কীভাবে এতজন প্রার্থীকে ভোট দেবেন। তাই ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানোর দাবি করেছেন তারা। তবে একমাত্র ছাত্রলীগ এ দাবির সঙ্গে নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৮টি হলে ভোট গ্রহণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে গড়ে প্রতিটি হলে দুই হাজার ২৬৩ জন ভোটার রয়েছেন। একজন ভোটারের ৩৮ প্রার্থীকে ভোট দিতে কমপক্ষে তিন মিনিট সময়ের প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্নেষকরা। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এ সময় আরও বেশি লাগতে পারে। প্রতি হলে দুই হাজার ২০০-এর বেশি শিক্ষার্থীর ভোট প্রদানে সময়ের প্রয়োজন ছয় হাজার ৬০০ মিনিট বা ১১০ ঘণ্টা। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ৬ ঘণ্টা। এ ক্ষেত্রে ওই সময়ের মধ্যেই ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করতে চাইলে প্রতিটি আবাসিক হলে পর্যাপ্ত পোলিং বুথ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে হলপ্রতি অন্তত ১৮টি পোলিং বুথের প্রয়োজন।

এ বিভাগের অন্যান্য