দুই বাংলার অভিনেত্রীদের নাচের লড়াই

১৫ অক্টোবর নাগরিক টিভিতে শুরু হবে রিয়ালিটি শো ‘বাজল ঝুমুর তারার নূপুর’। দুই বাংলার টিভি ও চলচ্চিত্রের ১৮ জন অভিনেত্রী দুই দেশের হয়ে নাচের লড়াইয়ে নেমেছেন। এই শোর গল্প জানাচ্ছেন উম্মে সালমা

 

রিয়ালিটি শোর প্রধান বিচারক ইলিয়াস কাঞ্চন দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, “বাংলাদেশের টেলিভিশনে এর আগে প্রতিযোগিতামূলক এ ধরনের অনুষ্ঠান হয়নি। ‘বাজল ঝুমুর তারার নূপুর’-এ রসবোধ আছে। আবার নাচিয়েদের ঠিকঠাক পারফরম করতে না পারার বেদনাও কম নয়!”

প্রধান বিচারক হিসেবে আছেন পশ্চিমবঙ্গের আরেকজন, শতাব্দী রায়। টালিগঞ্জের বাঘা বাঘা নির্মাতা একসময় তাঁর শিডিউল নিতে উন্মুখ থাকতেন। সেই তিনি অভিনয় ছেড়ে এখন ভারতীয় লোকসভার সদস্য!

শতাব্দী বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্ক সব সময়ই ভালো। আর এই অনুষ্ঠানটি ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব তৈরির প্ল্যাটফর্ম।’ মজা করে বলেন, ‘এখানে আমরা একেকজনকে নামে চিনব। তুমি কী খাও? এত লম্বা কী করে হলে? রোগা কেন? কিংবা এত ফরসাই বা হলে কী করে? সেসব বিষয়ে জানব।’

অনুষ্ঠানে সবচেয়ে লম্বা প্রতিযোগী জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া। শোতে যুক্ত হওয়ার আগে বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের অনেকের সঙ্গেই তাঁর খুব একটা মেলামেশা ছিল না! বললেন, ‘শোটা করতে গিয়ে আমরা একটা আত্মিক সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। কেউ কারো গন্তব্য সম্পর্কে জানি না, তবে সবার ভেতরে ভালো কিছু করার স্পৃহাটা যে আছে, সেটা অনুভব করতে পেরেছিলাম।’

অমৃতা খান জানালেন, কলকাতার অনেক শিল্পীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সাফা কবিরের সঙ্গেও তাঁর প্রথম পরিচয় এই শোর মাধ্যমে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুটি গ্রুপ আছে তাঁদের। এর মধ্যে কলকাতা ও বাংলাদেশের ১২ জন প্রতিযোগী মিলে হোয়াটসঅ্যাপে করেছেন একটি গ্রুপ। আর শুধু ঢাকার বন্ধুরা মিলে ফেসবুকে করেছেন আরেকটি গ্রুপ। নতুন তথ্য দিলেন অমৃতা, এই শোতে বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের সহশিল্পী হয়েছিলেন ভারতের ঋদ্ধিস। সেই ঋদ্দিস এখন নতুন ছবি ‘ও মাই লাভ’-এ তাঁর নায়ক।

কলকাতায় শুটিংয়ের দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো চমকে ওঠেন ইশানা। সুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শোবিজে এসেছেন তিনি। লড়াইয়ের ধাপগুলো তাঁর ভালোই জানা। কিন্তু এই রিয়ালিটি শো করতে গিয়ে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, এর সঙ্গে তাঁর পূর্বপরিচয় ছিল না! জানালেন, ঘুমানোর জায়গা ছিল এক জায়গায়, শুটিং আর রিহার্সাল হতো ভিন্ন ভিন্ন এলাকায়। একটি স্পট থেকে অন্যটির দূরত্বও অনেক! ‘কলকাতার প্রতিযোগীরা নাচে কতটা তুখোড়—এই লড়াইয়ে মুখোমুখি না হলে জানতেই পারতাম না। এ কারণেই আমরা সবাই নিজেদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি’—বললেন ইশানা।

আরো জানালেন, শুটিং শেষ হতো ভোর ৪টায়। ফিরে এসে বালিশে মাথা ফেলতে না ফেলতেই আবার ছুটে যেতে হয়েছে রিহার্সালে! কখনো এমনও হয়েছে, সারা রাত নাচ তুলে সকাল ৮টার কল টাইমে গিয়ে শুটিং স্পটে হাজির হতে হয়েছে। এত কষ্ট সয়েও কাজটি কেন করেছেন? ঈশানা পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘কখনো কি দেখেছেন যুদ্ধের ময়দান থেকে সাহসী সৈনিকদের পিছু হটতে?’

মাহিয়া মাহির কথা থেকে জানা গেল, নাচের প্রতিযোগিতায় আগে কখনোই অংশ নেননি। শুরুতেই বললেন, ‘এই শোর কথা মনে হলে এখনো বুকের ধুকধুক আওয়াজটা টের পাই!’

শো করার প্রস্তাব পাওয়ার পর দ্বিধায় ছিলেন, রাজি হবেন কি হবেন না। প্রতিযোগিতার ধরনটা বুঝে অনেক পরে সম্মতি দিয়েছিলেন। ‘লজ্জাবতীরে ছুঁইলে যেমন হয়ে যায়’, ‘ফাগুন এলে কোকিল ডাকে’সহ বেশ কয়েকটি গানে পারফরম করতে দেখা যাবে ‘অগ্নি’ অভিনেত্রীকে।

প্রথমবারের মতো নাচের প্রতিযোগিতায় যুক্ত হওয়া অভিনেত্রীর তালিকায় আছেন জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া, আশনা হাবীব ভাবনা, স্পর্শিয়া, সাফা কবির, অমৃতা খান ও সাদিয়া জাহান প্রভা। ব্যতিক্রম শুধু জাকিয়া বারী মম। এর আগে নাচের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

পশ্চিমবঙ্গের অভিনেত্রীদের মধ্যে মূল প্রতিযোগিতায় আছেন ছয়জন—‘ঝলক দিখলা যা—বাংলা’ বিজয়ী রিমঝিম, ‘অগ্নিজল’ সিরিয়ালখ্যাত সোহিনী সান্ন্যাল, ‘বিগ বস’-এর এনা সাহা, ‘জলনূপুর’ সিরিয়ালের লাভলী মৈত্র, ‘মা’ সিরিয়ালের তিথি বোস এবং ‘বিগ বস’ প্রতিযোগী প্রীতি। আরো আছেন জি বাংলার ‘রাশি’ সিরিয়ালের ‘রাশি’ চরিত্রের অভিনেত্রী গীতশ্রী এবং টালিউডের নায়িকা পায়েল মুখার্জি এবং ঋ।

রিমঝিম বলেন, ‘কম্পিটিশন তো কম্পিটিশনের জায়গাতেই! সবাই মূলত এনজয় করতে এসেছি। এবং বন্ধুত্ব বাড়াচ্ছি।’

উপস্থাপনায়ও দুই দেশের দুজন—বাংলাদেশের মাসুমা রহমান নাবিলা এবং পশ্চিমবঙ্গের সৌরভ দাস। দুজন মিলে মঞ্চে বিভিন্ন মজার দৃশ্যপটেও অবতীর্ণ হয়েছেন। নাবিলা বলেন, ‘উপস্থাপনা করেছি, অথচ আমাকেও টুকটাক নাচতে হয়েছে। নাচের শো বলে কথা!’

নাগরিক টিভির অনুষ্ঠান প্রধান কামরুজ্জামান বাবু জানালেন, ‘৭২টি পর্বে শেষ হবে নাচের এই লড়াই। দুই দেশের অভিনেত্রীরা সব মিলিয়ে পারফরম করবেন আড়াই শরও বেশিবার। নাচের মধ্যে ফিউশন, হিপহপ, মডার্নসহ ক্লাসিক্যালের বিভিন্ন ধারা তো আছেই।’

প্রধান বিচারকের সঙ্গে বিভিন্ন পর্বে অংশ নিয়েছেন অতিথি বিচারক। বাংলাদেশ থেকে অতিথি হয়েছেন মৌসুমী, ফেরদৌস, আঁখি আলমগীর, তৌকীর আহমেদ ও সজল। কলকাতা থেকে অতিথি হয়েছেন সংগীতশিল্পী জোজো, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র এবং নৃত্যবিশারদ তনুশ্রী শংকর।

প্রধান বিচারক এবং অতিথি বিচারকরা বিচারকার্যের পাশাপাশি প্রতিযোগীদের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে মঞ্চে নেচেছেনও। ১৫ অক্টোবর থেকে প্রতি সোম, মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় নাগরিক টিভিতে দেখা যাবে এই শো।

 

শরীরে মাটি মেখে ৬ ঘণ্টা ধরে শুকিয়েছি!

আশনা হাবীব ভাবনা

‘নৃত্য আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে’—এসব কথা আমার কাছে অবাস্তব লাগে। তেমনি অবাস্তব লাগে কোনো কিছু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে! কর্ম ও ভাগ্য—এই দুটি নিয়ে এগিয়ে চলতেই ভালোবাসি। আমার প্রথম স্কুল ছিল বুলবুল ললিতকলা একাডেমি।

যা হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। নাগরিক টিভি থেকে যখন আমাকে বলা হলো নাচের কম্পিটিশনে অংশ নিতে, লড়াই হবে কলকাতা বনাম বাংলাদেশের। ‘রক্তের সঙ্গে নৃত্য মিশে আছে’ কথাটা তখন ফলে গেল। কোনো কিছু না বুঝেই রাজি হয়ে গেলাম। প্রতিযোগিতার প্রথম দিনই বুঝে গেলাম, জেতার কোনো উপায় নেই! কলকাতার দলের একজন হয়ে গেল ‘ডান্সার অব দ্য ডে’! আরেকজন পেল ‘স্টেপ অব দ্য ডে’র খেতাব!

লড়াইটা এত কঠিন হবে আগে চিন্তাও করতে পারিনি। অনুষ্ঠানসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া করলাম। ঢাকায় ফিরে আসার কথাও ভাবলাম। কয়েক দিন এভাবে যাওয়ার পর হঠাৎ আমার মধ্যে দেশপ্রেম জেগে উঠল।

এরপর স্টেজে নাচতে গিয়ে পায়ে পেরেক ঢুকল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকলাম, সারা রাত জেগে গানের সঙ্গে নাচ তুলেছি। এমনও দিন গেছে, স্টেজের কোনায় কোনো রকমে জবুথবু হয়ে বসে থেকে কখন যে ক্লান্ত চোখ বুজে আসত টেরই পেতাম না! সেখানেই ঘুম।

আমাদের সাফা কবির, ইশানা, পিয়াকে দেখেছি দিনের পর দিন নৃত্যশিল্পী হিসেবে মেলে ধরতে। অমৃতা তো নাচেরই মেয়ে। তাকেও দেখেছি নাচে নিজেকে ভাঙতে, গড়তে। আমরা হয়ে গেলাম একে অপরের আত্মা। রিহার্সাল করছে একজন, আরেকজন খাবার বানিয়ে আনছে।

‘আল্লাহ মেঘ দে’ গানে নেচেছিলাম। তার জন্য ছয় ঘণ্টা পুরো গায়ে মাটি মেখে ফ্যানের নিচে বসে শুকাতে হয়েছিল। শুনেছিলাম স্টেজে নাকি আমাকে মূর্তির মতো লেগেছিল। তারপর জ্বর, কাশি। তবু থেমে যাইনি। লড়াইয়ে কে হারবে কে জিতবে, সেটা বড় কথা নয়। যে-ই জিতুক, বাংলাই জিতবে। কারণ আমাদের দুই দেশের শিল্পীদের মধ্যে যে সেতুবন্ধটা তৈরি হয়েছে, এটাই অনেক বড় পাওয়া।

এ বিভাগের অন্যান্য