সিসিকে অপরিকল্পিত উন্নয়ন  ৭ কোটি টাকা গচ্চা

সিলেটের সময় ডেস্ক:

সিলেট নগরীর যানজট নিরসনের নামে সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) দফায় দফায় প্রায় ৭ কোটি টাকার অপরিকল্পিত উন্নয়ন ভেস্তে গেল। এসব উন্নয়নের কোনোটিই কাজে আসেনি নগরবাসীর। বারবার সিসিকের এমন কাণ্ডে নগরজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এ জন্য অনেকেই কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্ন তুলেছেন। যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে রিকশার আলাদা লেন, অপরিকল্পিত রোড ডিভাইডার ও ফুটওভারব্রিজ নির্মাণের মাধ্যমে এ অর্থ অপচয় হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থায়ীভাবে চিন্তা না করে তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজে সিসিক কর্তৃপক্ষ বারবার জনগণের কোটি কোটি টাকা অপচয় করছে। এ জন্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাই দায়ী বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিসিকের বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচিত হওয়ার পর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) ট্রাফিক বিভাগের পরামর্শে নগরীর যানজট নিরসনে হকার উচ্ছেদ, ফুটপাত সংস্কার ও যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে রিকশা চলাচলের জন্য আলাদা লেন করেন। ২০১৪ সালে নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য পাঁচ কোটি টাকার টেন্ডার করা হয়। এর আওতায় হকার উচ্ছেদ, ফুটপাত সংস্কার ও আলাদা রিকশা লেন চালু করা হয়। এর সুফল পাওয়া শুরু হলেই সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় কারাবন্দি হন মেয়র আরিফ। এর পরপরই অজ্ঞাত কারণে রিকশা লেন উঠিয়ে অল্প দামে বিক্রি করা হয়। এরপর ২০১৬ সালের শেষের দিকে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর জেলরোড, জিন্দাবাজার, নাইওরপুল, বন্দরবাজার, সোবহানীঘাট, কোর্ট পয়েন্টসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে রোড ডিভাইডার বসানো হয়। কয়েকটি সড়কে ডিভাইডারের সুফল পাওয়া গেলেও সরু সড়কগুলোয় বাস-ট্রাক ঢুকলেই তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।

জেলরোড এলাকার বিসমিল্লাহ স্টোরের কর্মচারী দেলওয়ার হোসেন বলেন, সড়কের পাশে দোকান হওয়ায় অনেক দুর্ঘটনার সাক্ষী আমরা। রোড ডিভাইডারের কারণে এ সড়কে লোকজনকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ অবস্থায় সড়ক প্রশস্ত না করা হলে এসব ডিভাইডার তুলে নেয়ার দাবিতে সক্রিয় হন নগরবাসী ও ব্যবসায়ীরা। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নগর ভবনের সামনের ডিভাইডার তুলে দেয়া হলেও করিমউল্লাহ মার্কেটের সামনে রয়ে যায়। সম্প্রতি রাতের আঁধারে বন্দরবাজার, লালদীঘির পাড় ও কালীঘাট এলাকার ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ডিভাইডারগুলোর কিছু অংশ কেটে দেন খোদ সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এ সময় সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ইচ্ছায় নগরীর বন্দরবাজারের যানজট নিরসনে কালেক্টরেট মসজিদের সামনে ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে সিসিক ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের সময়ই ব্রিজটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি। যানজট নিরসনের জন্য ব্রিজটি স্থাপন করা হলেও এটি উল্টো যানজটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বছর দেড়েক পরিত্যক্ত থাকায় নগরীর সুবিদবাজার বা দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন রশীদ চত্বরে তা সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সিসিক। অর্থমন্ত্রীর সম্মতিতে এক বছর আগে গত রমজানে ব্রিজটি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিলেও এখন পর্যন্ত কোনো খবর নেই।

সিসিকের প্রকৌশল শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় মেয়র আরিফ কারান্তরীণ হলে ফুটপাত হকারদের দখলে যাওয়ার জন্য রিকশার পৃথক লেনকে দায়ী করা হয় এসএমপির ট্রাফিক বিভাগ ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে। দ্রুত রিকশার পৃথক লেন সরানোর জন্য চাপ দেয়া হয় সিটি কর্পোরেশনকে। যদিও ফুটপাত দখলমুক্ত থাকলে যানজট নিরসনে রিকশার পৃথক লেনে বিকল্প নেই, তবুও বাধ্য হয়ে সরানো হয়। তিনি বলেন, এরপর যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে এসএমপির ট্রাফিক বিভাগ ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে রোড ডিভাইডার নির্মাণের জন্য বলা হয়। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও বারবার তাগাদা দিলে ডিভাইডারও নির্মাণ করে দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে এই ডিভাইডার নগরবাসীর দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অপসারণের দাবিতে বন্দরবাজারে মানববন্ধন করেন ব্যবসায়ীরা। এতে একাত্মতা পোষণ করেন সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানও। সম্প্রতি এক রাতে ডিভাইডার কাটার খবর পেয়ে ছুটে আসেন কামরান। বর্তমান মেয়রের সঙ্গে পরামর্শ করে দু’জন মিলেই শুরু করেন এই ডিভাইডার কাটার কাজ। নগরীর বন্দরবাজারস্থ করিম উল্যাহ মার্কেটের সামনের ১৮ ফুট ডিভাইডার অপসারণ করা হয়। অপসারণের সময় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, এ ডিভাইডার অপসারণের ফলে নগরীর বন্দরবাজারসহ আশপাশের এলাকার লোকজন স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারবেন। পাশাপাশি এর মাধ্যমে রাস্তার উভয় পাশে যানবাহন ইউটার্ন করতে পারবে। এ সময় আরিফ-কামরানকে দেখে বন্দরবাজার পেপার পয়েন্টে জড়ো হন শতাধিক স্থানীয় ব্যবসায়ী ও উৎসুক জনতা। ব্যবসায়ীদের এ দাবি মেনে নেয়ায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান ব্যবসায়ীরা।

সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক মোস্তাক আহমদ জানান, নগরীর চৌহাট্টা-রিকাবীবাজার ভিআইপি সড়কে অপরিকল্পিতভাবে রোড ডিভাইডারের কারণে ভোগান্তি বাড়ছে সাধারণ মানুষের। জিন্দাবাজার জল্লারপাড় থেকে দরগা মহল্লা যেতে হলে ডিভাইডারের কারণে অন্তত আধা কিলোমিটার দূরের রিকাবীবাজার ঘুরে যেতে হয়। একইভাবে এ পথে আম্বরখানা যেতে হলেও পুলিশলাইন, দরগা মহল্লা ঘুরে কিংবা রিকাবীবাজার ঘুরে যেতে হয়।

নগরীর শিবগঞ্জের আবদুল হালিম জানান, সিলেট নগরীর বন্দরবাজারের ফুটওভারব্রিজ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। দ্রুত চলতে গিয়ে সাধারণ মানুষ এ ফুটওভারব্রিজ এড়িয়ে চলেন। কারণ এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী  বলেন, দেশে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব তার প্রমাণ সিসিকের এমন কর্মকাণ্ড। টেকসই উন্নয়নের জন্য সিসিক কর্তৃপক্ষের একটি গবেষক টিম প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানো যেতে পারে। নগরবিদ ড. জহির বিন আলম  বলেন, সিসিক কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, তারা তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজছেন। এটা কাজে আসবে না। যানজট নিরসনের স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে। ভারতের বোম্বে শহরের মতো চতুর্থদিকে একটি টান্সপোর্ট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পাবলিক টান্সপোর্ট বাড়াতে হবে প্রাইভেট নয়। তাহলেই নগরীতে যানবাহনের চাপ কমবে।

যানজট নিরসনে ‘রিকশার পৃথক লেন’র বিকল্প নেই স্বীকার সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (ট্রাফিক) নিকুলন চাকমা  বলেন, সিসিকের নির্মিত লেনগুলো সরু হওয়ায় ফলপ্রসূ হয়নি। দুটি রিকশা যাতায়াতের জায়গা না থাকায় লেনগুলোও দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমরা তুলে ফেলার জন্য বলি। এরপর এসএমপি বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করে নগরীর যেখানে রোড ডিভাইডার প্রয়োজন সেখানে বসিয়েছে। এগুলোকে অপরিকল্পিত ডিভাইডার বলার কোনো সুযোগ নেই।

রিকশার পৃথক লেন ফলপ্রসূ হয়েছিল দাবি করে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী  বলেন, আমি সরকারের হেফাজতে চলে যাওয়ার পর কার স্বার্থে, কী কারণে রিকশার লেনগুলো তোলা হয়েছিল জানি না। আবার রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা হল। এটি আরও বড় দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াল। নগরবাসী ও ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ডিভাইডার অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে। খুব শিগগির ফুটওভারব্রিজও স্থানান্তর করা হবে। মেয়র বলেন, যান চলাচলে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ট্রাফিক বিভাগের। তাই যানজট নিরসনে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।সূত্র যুগান্তর

এ বিভাগের অন্যান্য