সিলেটের ইফতারি বাজার আখনি ছাড়া রোচে না মুখ

মবরুর আাহমদ সাজু

ভিন্নতা আর প্রাচুর্যের মিশেলে নানান স্বাদের ইফতারির পসরা নিয়ে রমজানের প্রথম দিনেই জমে উঠেছে সিলেট মহানগরীর ইফতারি বাজার। আর বড়-ছোট সব হোটেলেই মিলছে স্বাদে নতুনত্ব আর আঞ্চলিকতার ছোঁয়া নিয়ে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী খাবার আখনি। অনেকটা বিরিয়ানির মতো হলে আখনি বেশ মসলাবহুল খাবার। খেতে কিছুটা ঝাঁজালোও। ইফতারের সময় সিলেটবাসীর ‘আখনি’ না হলে যেন চলেই না। আখনি এখন রীতিমতো ইফতারের আভিজাত্য হয়ে উঠেছে। যেকোনো ইফতারের অনুষ্ঠানে অবশ্যই আখনি থাকতে হবে। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় একসময় ঘরে ঘরে তৈরি হলেও আখনি এখন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবছর রমজান মাসে নগরজুড়ে ইফতারসামগ্রীর বেচাকেনার ধুম পড়ে যায়। এবারও রমজানের দ্বিতীয় দিনেই জমজমাট হয়ে উঠেছে সিলেটের ইফতারি বাজার। আর সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে আখনি। এ ছাড়া রমজান মাসজুড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ইফতার পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রধান পদ হিসেবে পাঠানো হয় অতুলনীয় স্বাদের আখনি।

স্থানীয় এক বাবুর্চি জানাল, পোলাও চাল ও গরুর মাংস দিয়েই মূলত আখনি তৈরি করা হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তনও এসেছে খাবারটিতে। এখন খাসির মাংস ও মোরগের মাংস দিয়েও আখনি বানানো হয়। সে ক্ষেত্রে এর নাম হয়ে যায় খাসির আখনি অথবা মোরগ আখনি। মাংস ও মানভেদে আখনি প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সিলেটের হোটেলগুলোয়।

রোজার সময় দেশের অন্যসব জেলা থেকে সিলেটের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আসে। আর খাদ্য তালিকাটিও থাকে ভিন্ন। সিলেটের ইফতারের ভিন্নতা হলো ইফতারের সময়ই রাতের খাবার সেরে নেওয়া হয়। এর পরে আর সেহরি খাওয়া হয় না। আর সে কারণেই সিলেটের ইফতারে মূলপদ হিসেবে আখনির এত কদর। আখনি ছাড়া ইফতারের বড় আয়োজন কল্পনাও করতে পারেন না সিলেটের মানুষ।

সিলেটের ইফতার সংস্কৃতির অন্যতম অংশ হলো মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি পাঠানো। এটা একটি সামাজিক রেওয়াজ। রমজান মাসজুড়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি পাঠানোর জন্য রীতিমতো উৎসবমুখর হয়ে ওঠে সিলেট অঞ্চল। আগে নানা পদের ইফতারি তৈরি করে সেগুলো মেয়ের বাড়িতে পাঠানো হলেও নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় এখন ঘরে বানানো ইফতারির পরিবর্তে বাজার থেকে কেনা ইফতারি পাঠানো হয়। সাধারণত দুই দফায় পাঠানো হয় ইফতারি। রমজানের প্রথম দিন একবার ছোট আকারে আবার রমজানের মাঝামাঝিতে ইফতারি পাঠানো হয় বড় পরিসরে। সেগুলো দিয়ে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ান মেয়ের বাড়ির লোকজন।

বিয়ের ‘উকিল বাবা’র পক্ষ থেকেও কনের বাড়িতে ইফতারি পাঠানোর প্রচলন রয়েছে সিলেটে। নগরায়ণের ফলে অনেক কিছু বদলে গেলেও মেয়ের বাড়িতে ইফতারি পাঠানোর রেওয়াজ এখনো সমানভাবে টিকে আছে নগর থেকে অজপাড়াগাঁ পর্যন্ত। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি পাঠানোর বেলায় সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় আখনির ওপর।

ইফতারে সিলেটের আরেক অনুষঙ্গ হলো বাখরখানি। তারাবির নামাজের পর হালকা খাবার হিসেবে এককাপ চা এর সঙ্গে বাখরখানি খাওয়াটাও এখানে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। আকারভেদে প্রতিটি বাখরখানির আট থেকে শুরু করে ২০ টাকা দামে বিক্রি হয়।

ইফতার প্রস্তুতির জন্য রমজান শুরুর দু-এক দিন আগ থেকেই সিলেটের অভিজাত হোটেল থেকে শুরু করে ফুটপাতে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। নগরের বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, আম্বরখানা, সুবিদবাজার, মদিনা মার্কেট, রিকাবীবাজার, মীরাবাজার, শিবগঞ্জ, টিলাগড়সহ শহরের প্রায় প্রতিটি পাড়ায় বসে ইফতারির ছোট বড় দোকান। রাস্তার পাশের খাবার দোকান, রেস্তোরাঁগুলোর সামনে কাপড় দিয়ে সামিয়ানা টানিয়ে ইফতারসামগ্রী পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। প্রতিদিন দুপুর থেকেই পুরোদমে কেনাবেচা শুরু হয়ে যায়। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ভিড়। ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুনি, জিলাপি, আলুর চপ, ডিম চপ, সবজির বড়া, হালিম, চিকেন উইংস, ফ্রাইড চিকেন, ইরানি কাবাব, রেশমি কাবাব, চিকেন রোস্ট, টিকেন রোলসহ দোকানভেদে নানা উপকরণ বিক্রি হয়। তবে সব দোকানেই রাখা হয় আখনি, বাখরখানি, ভুনা খিচুড়ির মতো স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার। একসময়ে মিষ্টান্নের মধ্যে আমৃতির বেশ খ্যাতি ছিল সিলেটে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এটার আবেদন কমে যাচ্ছে।

খেজুর, ছোলার মতো ইফতারির নিয়মিত অনুষঙ্গের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশেষ খাবারগুলোও এখন সিলেটের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর থেকে ব্যতিক্রমী ইফতারি অনুষঙ্গের জন্য দৃষ্টি কেড়েছে জিন্দাবাজারের পালকি রেস্টুরেন্ট। গতকাল শনিবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল ক্রেতাদের ভিড়। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মো. তাহির উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বললেন, ‘এ বছর আমরা এক শর মতো আইটেম এনেছি। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোও এখানে পাওয়া যাচ্ছে। পালকি রেস্টুরেন্টের স্পেশাল আইটেমগুলোর মধ্যে রয়েছে- বড় বাপের পোলায় খায়, লেমন চিকেন, ফ্রাইড চিকেন, চিকেন শাশলিক, চিকেন বলস্টিক, বিফ কাটি কাবাব, মাটন কাটি কাবাব, চিকেন উইংস ও ফ্রাইড চিকেন। মিষ্টান্নের মধ্যে রয়েছে দই বুন্দিয়া, রেশমি জিলাপি, স্ট্রবেরি ফিন্নিসহ বেশ কয়েকটি পদ।

সিলেটের তারকামানের হোটেলগুলো ইফতার পার্টি আয়োজনের ক্ষেত্রেই বেশি জোর দিচ্ছে। তিন তারকা হোটেল নিরভানা ইন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাহমিন আহমদ বললেন, ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইফতার পার্টির কথা মাথায় রেখে আমরা সেট মেন্যু করেছি। ২০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে এসব মেন্যু সাজানো হয়েছে।

এ বিভাগের অন্যান্য