গাড়িচালক সৌদি নারী নিজের জীবনের চালক হবেন কবে?

১৯৯০ সালের একদিনের ঘটনা। সৌদি আরবের রিয়াদ শহরের রাস্তায ৪৬ জন নারীকে গাড়ি চালাতে দেখা যায়। সবাই চাকরিজীবী নারী। এ ঘটনার পর তাদের সবাইকে শাস্তি হিসেবে যার যার কর্মস্থল থেকে বরখাস্ত করা হয়। শুধু তাই নয়, তাদের দেশের বাইরে যাওয়ার উপরও নিষেধজ্ঞা জারি করা হয়।

২০০৮ সালের আগস্টের আরেক দিন। দুঃসহ গরমের মধ্যে ওয়াজেদা নামের এক সৌদি নারী তার আবায়া (বোরকা বা কালো আলখাল্লা) ছুঁড়ে ফেলে বাহরাইন ও সৌদি আরবের সীমান্তবর্তী সেতুতে এসে ‘গিভ উইমেন দেয়ার রাইট’ লেখা প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। বছর দুই পর এই ওয়াজেদাই মরভূমিতে গাড়ি চালিয়ে তার তিন মিনিটের ভিডিও ইউটিউবে ছেড়ে দেন।

২০১১ সালে মানাল আল-শরীফ নামের আরেক নারীকে গাড়ি চালানোর অপরাধে নয় দিন জেল খাটতে হয়। তখন ইমামরা তাকে চাবুক মারার দাবি জানান।

২০১৪ সালে আরেক নারী আরব আমিরাত থেকে গাড়ি চালিয়ে সৌদি আরবে প্রবেশ করলে তাকে ধরে নিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হয়। সেখানে তাকে ৭৩ দিন থাকতে হয়।

এভাবে বেশ কজন সাহসী সৌদি নারী আইন ভেঙে গাড়ি চালিয়ে রাস্তায় বের হয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। কেউ কেউ কারারুদ্ধ হয়েছেন। কাউকে কাউকে আবার চাবুকও মারা হয়েছে।

এত দিন আমরা জানতাম, সৌদি আরব বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে নারীরা গাড়ি চালাতে পারেন না। কিন্তু সামনের বছর থেকে দৃশ্রপটে পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। ২৭ সেপ্টেম্বর এক ডিক্রিবলে সৌদি সরকার ঘোষণা করেন, এবার থেকে নারীরা গাড়ি চালাতে পারবেন। এর আগে অবশ্য এ নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তারা নারীদের গাড়ি চালানো-সম্পর্কিত নানা দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রিপোর্ট দেবে। ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে এই ডিক্রি কার্যকর হবে। শরিয়া আইন, ওয়াহাবি নীতি, আরবীয় সামাজিক আচার সব কিছুর নিরিখে নারীদের গাড়ি চালানোর বিষয়ে থাকবে কিছু বাধ্যবাধকতা।

 

A Saudi woman poses in this picture to illustrate driving a car in Jeddah June 17, 2011. Saudi Arabia has no formal ban on women driving. But as citizens must use only Saudi-issued licences in the country, and as these are issued only to men, women drivers are anathema. Outcry at the segregation, which contributes to the general cloistering of Saudi women, has been fuelled by social media interest in two would-be female motorists arrested last month. Picture taken June 17, 2011. REUTERS/Susan Baaghil (SAUDI ARABIA - Tags: SOCIETY) - RTR2NW31
সামনের বছর থেকে দৃশ্যপটে পরিবর্তন ঘটতে চলেছে

 

অনেকের হয়তো মনে আছে কিছুদিন আগে সে দেশে সাদ আল-হিজরা নামের এক ধর্মীয় নেতা, যিনি আসির প্রদেশের ফতোয়া নেতা, বলেছিলেন, “নারীদের মগজ পুরুষের চেয়ে অর্ধেক। তারা শপিংএ গেলে মগজ আরও সংকুচিত হয়ে যায়। তখন পুরুষের মগজের তুলনায় নারীদের মস্তিস্ক এক চতৃুর্থাংশ থাকে। এই মগজ নিয়ে নারীরা গাড়ি চালাতে পারবে? একজন পুুরুষের মস্তিস্কও যদি স্বাভাবিকের চাইতে এক চতুর্থাংশ থাকে তাকে কি কর্তৃপক্ষ গাড়ি চালাবার লাইসেন্স দিবে?”

টুইটারে সে ব্যক্তির এ স্ট্যাটাস ছড়িয়ে পড়লে ২৪ ঘণ্টায় ১ লাখ উনিশ হাজার হ্যাশট্যাগ পড়ে। এ ঘটনার পর সেই ধর্মীয় নেতাকে সকল ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে বাদ দেওয়া হয়। কারণটা কি নারীকে অপমান করার জন্য? তাই কি মনে হয়? তা-ও আবার সৌদি আরবে?

আসলে রাজপরিবার যেখানে চাচ্ছে নারীরা গাড়ি চালাক সেখানে এ ধরনের মন্তব্য বরদাস্ত হবে কেন? এখনও সৌদি আরবের যে কোনো নারীকে আইনি বা রাষ্ট্রীয় বা বৈষয়িক বেশিরভাগ কাজে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হয়। তা ভ্রমণ, পড়াশোনা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা– যা কিছুই হোক না কেন। এটা কি নারীদের জন্য খুব একটা সম্মানজনক? এসব আইন প্রমাণ করে যে, নারীদের অর্ধেক মানব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্ধেক মানবের তো অর্ধেক মগজ থাকবে।”

নারীদের নিয়ে এ ধরনের অসভ্য মন্তব্য এর আগেও সৌদি আরবের বহু ধর্মীয় নেতা করেছেন। কই, তখন তো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?

২০১৩ সালে সৌদি নারীরা এটিভি নামের এক ধরনের মোটর বাইক চালানোর অধিকার পায়। তবে শর্ত ছিল, তারা শুধু বিনোদন এলাকায় সেটি চালাতে পারবেন, সম্পূর্ণ ইসলামিক পোশাক পরে এবং সঙ্গে থাকতে হবে একজন পুরুষ আত্মীয়। গাড়ি চালানোর ব্যাপারেও এ ধরনের শর্ত জুড়ে দেওয়া হবে নিঃসেন্দহে। শর্তগুলো শোনা যাচ্ছে এমন, তারা শুধু কর্মস্থলে আসা-যাওয়া বা দোকানপাট করার নিমিত্তে গাড়ি চালাতে পারবেন, কোনো জয়রাইডিং নয়। অর্থাৎ বন্ধুবান্ধব মিলে বা পরিবারের মানুষদের নিয়ে কোনো লংড্রাইভে নয়। সম্ভবত তাদের গাড়ি চালানোর সময়কালের একটা গণ্ডি বেঁধে দেওয়া হবে।

তারপরও মন্দের ভালো হিসেবে সৌদি নারীরা তো বটেই গোটা দুনিয়ার নারীঅধিকারের জন্য সোচ্চার ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো এই ডিক্রিকে স্বাগত জানিয়েছে। সৌদি নারীরা রীতিমতো উল্লাস প্রকাশ করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও অন্যত্র।

‘তবে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’, বলছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞ। পদক্ষেপটি মোটেও সৌদি নারীর সমানাধিকার স্বীকার করা থেকে হয়নি, এর পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়। এই ডিক্রি জারির কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বড় বড় গাড়ি নির্মাতা বিজ্ঞাপন ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের সব চমক-লাগানো শ্লোগান শুনে মনে হবে, সৌদি নারীরা বুঝি জীবনের সব ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার পেয়ে গেছেন! ফোর্ড গাড়ি নিমার্তাদের বিজ্ঞাপন ছিল সবচেয়ে মনোগ্রাহী– ‘ওয়েলকাম টু দা ড্রাইভার সিট’ লেখা এ বিজ্ঞাপনে সম্পূর্ণ কালো এলাকাজুড়ে দেখা গেছে গাড়ির রিয়ারভিউ আয়নায় একজোড়া নারীর চোখ। নিশান ভক্সওয়াগানও তাদের মতো করে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেছে– অবশ্যই নারী গাড়িচালকদের লক্ষ্য করে।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গাড়ি আমদানি করে সৌদি আরব। গাড়ির বাজারে তাদের অবস্থান ১৯৮এর মধ্যে ২১তম। হিসাব করে দেখা গেছে, এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পর গাড়িবিক্রেতারা ৮০ লাখের মতো সম্ভাব্য ক্রেতা পাবে। অর্থাৎ ৮০ লাখ সৌদি নারী গাড়িচালককে নতুন গাড়ি ক্রেতা হিসেবে ধরা হচ্ছে।। এদের বয়স ১৫ থেকে ৫৪ বছর। সৌদি আরবে বসবাসরত ২৭ লাখ বিদেশি নারীকে অন্তর্ভুক্ত করলে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। অনেক বাড়িতে যে গাড়ি নারী বা সন্তানদের চলাচলের জন্য নির্ধারণ করা ছিল সেটি এখন পরিবারের নারী সদস্যরা চালাবেন। সুতরাং এত নতুন গাড়ি না-ও বিক্রি হতে পারে। তবে অধিকাংশের মত, এখন না হলেও কিছুদিন পর নারীরা তাদের নিজস্ব গাড়ির দাবি করতে পারেন। সে হিসেবে ক্রতা বাড়বেই।

মজার বিষয় হল, গোটা সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানো অপরাধ নয়। বিখ্যাত তেল কোম্পানি আরামকোর দাহরাম কম্পাউন্ডে নারীদের গাড়ি চালাতে দেখা যায়। আবার বেদুইন নারীরা লাইসেন্স ছাড়াই মরুভূমিতে বড় বড় ট্রাক চালান।

 

Saudi women - 10111
সৌদি আরবে গ্রাজুয়েট পুরুষের তুলনায় গ্রাজুয়েট নারীর সংখ্যা বেশি

 

এককালে পেট্রো ডলারে পুষ্ট সৌদি আরবের অর্থনীতি ক্ষীয়মান এখন। বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিক নিয়ে আর কতদিন চলবে? তাদের টনক নড়ছে। তারা শুধু আমদানি নয়, নিজ দেশে বিদেশি বিনিয়োগের উপরও জোর দিচ্ছেন। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে সম্ভবনাময় খাত অটোমোবাইল শিল্প। সে জন্যও নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া দরকার ছিল। শুধু নারীরা নন, যুবকরাও সেখানে গাড়ি শিল্পের টার্গেট। সৌদি নাগরিকদের গড় বয়স ২৭ বছর। তাদের জনসংখ্যার অর্ধেকের বয়স ২৪ বছরের নিচে। ২০ বছর ধরে সৌদি আরব তার গাড়ি শিল্পের বিকাশের চেষ্টা চালাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেক ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে জাপান, ইটালি, সুইডেন ও ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে গাড়ি নির্মাণ হচ্ছে সেখানে। সৌদি আরবের লক্ষ্য ২০১৫ সাল নাগাদ তারা ছয় লাখ গাড়ি নিজেরাই তৈরি করবে।

নারীদের গাড়ি চলানোর অনুমতি দিয়ে সৌদি আরব তার অর্থনীতি চাঙ্গা করতে চাইলেও, এই নিষেধাজ্ঞা উঠলে প্রাইভেট গাড়িচালকদের অনেকের কপাল পুড়বে। সৌদি আরবে প্রায় আট লাখ বিদেশি গাড়িচালক রয়েছেন। এদের সিংহভাগ দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগত, বাংলাদেশি চালকও রয়েছেন প্রচুর। এদের গড় মাসিক বেতন ৪০০ ডলার এবং তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুবিধা রয়েছে। তাদের অন্যত্র চাকরি দেখতে হবে বা সৌদি আরব ত্যাগ করতে হবে। আরও যাদের কপালে চিন্তার রেখা পড়েছে তারা হল উবার এবং ঐ ধরনের অ্যাপ-নির্ভর ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস। তাদের যাত্রীদের শতকরা আশি ভাগই নারী।

সৌদি আরবে নারীদের অবস্থান গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৬ অনুযায়ী ১৪৪এর মধ্যে ১৪৩তম। সৌদি সরকার এ বিষয়ে এখন একটু নড়েচড়ে বসছে। ভিশন ২০৩০ নামে তারা একটা পরিকল্পনা নিয়েছে সেখানে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, সৌদি আরবে গ্রাজুয়েট পুরুষের তুলনায় গ্রাজুয়েট নারীর সংখ্যা বেশি। একটা বিরাট মানবসম্পদ অলস পড়ে আছে। অবশ্য তারা তো এত দিন নারীকে মানব বলেই মনে করত না। সুতরাং তারা আর মানবসম্পদ হল কীভাবে?

গত ডিসেম্বরে একদল সৌদি নারীর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে তারা তাদের সেই আবায়া পরে বেসবল খেলছেন, নাচছেন এবং খেলনা গাড়ি চালাচ্ছেন। মূলত সৌদি নারীদের প্রায় সকল ক্ষেত্রে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নেওযার যে বিধান সেটির প্রতিবাদে ছিল এ ভিডিও।

মানাল আল-শরিফ যিনি ‘উওম্যান হ্যাস ড্রাইভ’ নামে এ ক্যাম্পেইন শুরু করেছিলেন সেই নব্বই দশকে, এই ডিক্রি জারির পর বলেন, ‘ছোট একটা ফোঁটা দিয়ে বৃষ্টি শুরু হল।’

গাড়ি চালানোর অধিকারের পর সৌদি নারীরা আশায় বুক বাঁধছেন একদিন তারা নিজেদের জীবন চালানোর অধিকারও পাবেন। পুরুষ অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে চলার দিন বুঝি শেষ হয়ে এল।

এ বিভাগের অন্যান্য